উত্তম চর্চা: স্বীকৃতি পাচ্ছে ২৪ প্রতিষ্ঠান
উৎপাদন ক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় উত্তম চর্চার স্বীকৃতি হিসেবে দেশের পাঁচ খাতের ২৪টি কারখানাকে পুরস্কৃত করতে যাচ্ছে সরকার। আজ জাতীয় ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরস্কার প্রদান করবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
কারখানা মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ বিষয়ে মালিকদের উৎসাহিত করতে সরকার গত বছর থেকে ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি উত্তম চর্চা পুরস্কার’ প্রবর্তন করে। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয়বারের মতো এ আয়োজনে এবার পোশাক খাতে ১২টি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল, চামড়া, চা ও পাট খাতের তিনটি করে প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, গতবারের ধারাবাহিকতায় এবার বিভিন্ন খাতের ২৪টি কারখানাকে ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি উত্তম চর্চা পুরস্কার’ প্রদানের জন্য মনোনীত করেছি আমরা। রোববার (আজ) সংশ্লিষ্ট কারখানা মালিকদের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।
পোশাক খাতের মনোনীত কারখানাগুলোর মধ্যে পাঁচটি নিট পণ্য এবং সাতটি ওভেন পণ্য প্রস্তুত করে। নিট পণ্যের কারখানাগুলো হচ্ছে, প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেড, উইজডম এ্যাটায়ারস লিমিটেড, নাফিসা এপারেলস লিমিটেড, মাদার কালার লিমিটেড এবং ফতুল্লা এ্যাপারেলস। পুরস্কারের জন্য মনোনীত ওভেন পণ্যের কারখানাগুলো হলো কমফিট কম্পোজিট নীট লিমিটেড, লায়লা স্টাইলস লিমিটেড, ইকোফ্যাব লিমিটেড, অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেড, ক্রাউন ওয়্যারস (প্রা.) লিমিটেড, ইপিলিয়ন স্টাইল লিমিটেড এবং জাবের এন্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড।
ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেড; চামড়াজাত পণ্য খাতে ম্যাফ সুজ লিমিটেড, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড ও পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেড; চা খাতে জেরিন প্লান্টেশন লিমিটেড, মধুপুর টি এস্টেট ও শমসেরনগর টি এস্টেট এবং পাটজাত পণ্য খাতে জনতা জুট মিলস লিমিটেড, ওহাব জুট মিলস লিমিটেড এবং নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড এ পুরস্কার পাচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শিল্প-কারখানায় উত্তম চর্চা যাচাইয়ে কিছু মাপকাঠি, নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে শ্রম আইনের আলোকে একটি প্রশ্নমালা পাঠানো হয় খাতভিত্তিক সংগঠনগুলোকে। সংগঠনগুলো সেই মাপকাঠি অনুসরণ করে যোগ্য কারখানাগুলোর কাছে উত্তর চেয়ে পাঠায়। কারখানা কর্তৃপক্ষের পাঠানো উত্তর সংগঠনগুলো পাওয়ার পর তা আবার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটি উত্তর ও নিজস্ব যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চূড়ান্ত কারখানাগুলোকে মনোনীত করে।
শ্রম আইনের আলোকে মন্ত্রণালয়ের যাচাইকৃত বিষয়গুলোর মধ্যে আছে কারখানায় আইন নির্ধারিত কর্মঘণ্টা অনুসণ হয় কিনা, শ্রমিকের মৃত্যু-ছাঁটাই-ডিসচার্জ-অবসান-স্বেচ্ছাবসান-অবসর-নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে চাকরি ছেদজনিত প্রাপ্য পাওনাগুলো আইনমাফিক পরিশোধ করা হয় কিনা, আইন মোতাবেক নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদানসহ মাতৃত্বকালীন সুবিধা প্রদান করা হয় কিনা, শারীরিক, মানসিক বা যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে অভিযোগ আনয়নের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা রয়েছে কিনা ও বিধি মোতাবেক শিশু কক্ষ আছে কিনা।
যাচাই-বাছাইয়ের মাপকাঠির মধ্যে আরো আছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি সামগ্রিকভাবে পরিচ্ছন্ন এবং স্বাস্থ্যসম্মত কিনা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, সহনীয় শব্দের মাত্রা এবং আরামদায়ক উষ্ণতা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় কিনা, বিধান মোতাবেক প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয় কিনা, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে আইনানুগ সুবিধা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রদান করা হয় কিনা, কারখানার সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিধান মোতাবেক আছে কিনা, কারখানায় সেফটি কমিটি রয়েছে কিনা, পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি সংক্রান্ত কোনো উদ্বুদ্ধকরণ এবং চিত্তবিনোদনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি আছে কিনা। এ বিষয়গুলোর আলোকেই মোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে পুরস্কারের জন্য সেরা প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত করা হয়।
এ বছর ১০০-এর মধ্যে ১০০ নম্বর পেয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের নিট পণ্য প্রস্তুতকারক কারখানা প্লামি ফ্যাশনস। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় দুই হাজার কর্মী কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক রফতানির পরিমাণ ২৫ মিলিয়ন ডলার।
যোগাযোগ করা হলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, এটা ভালো উদ্যোগ। এ উদ্যোগের কথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন, যাতে শিল্প-কারখানার মালিকরা পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে আরো অনুপ্রাণিত হন। দেশের সব শিল্প খাতেই এ সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। উন্নত দেশ হতে হলে শুধু মাথাপিছু আয় দিয়েই তা সম্ভব না, সবকিছুতেই উন্নত থাকতে হবে। আর সেই প্রেক্ষাপটেই পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সব শিল্প খাতের জন্যই জরুরি।
পোশাক শিল্পের ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারকদের মধ্যে পুরস্কার পেতে যাচ্ছে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার, বার্ষিক রফতানির পরিমাণ ১১২ মিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক খান বলেন, কারখানায় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। এতদিন শুধু সেফটি নিয়ে আলোচনা হলেও এখন স্বাস্থ্যের বিষয়টিও অগ্রাধিকার পাচ্ছে। যথাযথভাবে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে সরকার স্বীকৃতিও দিচ্ছে। নানামুখী প্রেক্ষাপটে আজ সবাই সচেতন হতে শুরু করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতে এখন বিশ্বমানের কারখানা রয়েছে। এ বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা অনুধাবন করেছেন। ভবিষ্যতে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ আরো ভালো করবে বলে আশা করছি।
ওষুধ শিল্পের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটিতে মোট কর্মসংস্থান হয়েছে ৪ হাজার ২৫৬ জনের, আর বার্ষিক টার্নওভার ১ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। কারখানায় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি সম্পর্কে জানতে চাইলে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক ও কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ বলেন, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি বর্তমানে খুব গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকেই এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছে। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো সব শিল্পে যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের শিল্পায়নে সুদূরপ্রসারী সুফল বয়ে আনবে। আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনেও পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় উত্তম চর্চার স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে চামড়াজাত পণ্য খাতের প্রতিষ্ঠান পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেডও। প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন প্রায় ১ হাজার ৬০০ জন, বার্ষিক রফতানির পরিমাণ ২৫ মিলিয়ন ডলার। পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়ফুল ইসলাম বলেন, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি একবার নিশ্চিত করলে হয় না, ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখতে হয়। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিগুলো অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থানীয় মানদণ্ড ঠিক করা হচ্ছে। এ মাপকাঠিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা কারখানায় সেগুলো বাস্তবায়ন করি। বিশ্বব্যাপী যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলোর ধরন ও প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় দুই ক্ষেত্রে মাপকাঠির পরিবর্তন ও কারখানা পর্যায়ে সেগুলো প্রয়োগ করতে হচ্ছে। আমাদের দেশ এখন উন্নত দেশে উন্নীতের প্রক্রিয়ায় আছে। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ হবে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব, তখন টেকসই হতে হলে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, বৃদ্ধি করতে হবে দক্ষতা আর পাশাপাশি উন্নত হতে হবে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পুরস্কারের জন্য মনোনীত আরেক প্রতিষ্ঠান জনতা জুট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হক বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর শিল্পসংশ্লিষ্ট সবার টনক নড়েছে। এ ঘটনার পর শিল্পোদ্যোক্তা থেকে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়তে শুরু করেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব মূল্যায়নে নতুন হেলথ অ্যান্ড সেফটি-সংক্রান্ত মানদণ্ড বা মাপকাঠি প্রয়োগ করছি। রানা প্লাজার ঘটনাটি শ্রমিক, মালিক এবং জাতীয়ভাবে হেলথ অ্যান্ড সেফটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সার্বিকভাবে মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে শিল্পসংশ্লিষ্টদের। আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। পুরস্কার পাওয়ার মতো স্বীকৃতি মানসিকতা পরিবর্তনের প্রতিফলন।