গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের উদবিঘ্ন

গত এক বছরে মজুরি বেড়েছে প্রায় সব শিল্পে। পাশাপাশি বেড়েছে ব্যাংকঋণের সুদ। এর মধ্যেই আলোচনা চলছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির। সব মিলিয়ে খরচ বেড়ে যাওয়ার চাপে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবকিছু ছাপিয়েও তাদের বেশি চাপে ফেলছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। গ্যাসের নিম্নচাপ, অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত সরবরাহ এবং প্রকৃত ব্যবহারের চেয়ে বেশি বিল পরিশোধ এ চাপকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে আছে মজুরি বৃদ্ধি ও ব্যাংকঋণের উচ্চসুদ। এসব হিসাবে নিলে গত এক বছরে ব্যবসার খরচ বেড়েছে গড়ে ১০ শতাংশের বেশি।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে দেশের বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীদের। এ খাতের বড় মিলগুলো চলে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বা নিজস্ব বিদ্যুতে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামো তৈরির পর জেনারেটর আমদানিসহ অন্যান্য স্থাপনার জন্য বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে।

এ বিনিয়োগ হয় মূলত উচ্চসুদের ব্যাংকঋণে। সম্প্রতি এ খাতে শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়লে খরচ আরো বেড়ে যাবে, যা এ খাতে ৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, সব শ্রেণীর গ্যাসের দাম গড়ে ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ক্যাপটিভ পাওয়ারের গ্যাসের দাম ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬২ পয়সা থেকে ১৫ টাকা ৭০ পয়সার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। শিল্প খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।

এ হারে গ্যাসের দাম বাড়লে বস্ত্র খাতের মতোই খরচ বেড়ে যাওয়ার চাপে রয়েছে সিমেন্ট শিল্প। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়লে ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। সিমেন্টের দামে কী পরিমাণ প্রভাব পড়বে, এখনই তা বলা না গেলেও নিশ্চিতভাবেই বাড়বে।

বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা বারবার বলছিলাম, এরই মধ্যে চাপের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ীরা।

সরকার মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে বলেছে, তা হয়েছে। জীবনযাপনের ব্যয় যেহেতু বাড়ছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে মজুরি বৃদ্ধি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের অনুরোধ ছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার। এটা সব শিল্পের জন্যই অতিরিক্ত চাপ। বিশেষ করে টেক্সটাইল খাতে কাঁচামালের পর গ্যাসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।

একটা সময় যখন বিদ্যুৎ নিয়ে সংকট ছিল, তখন সরকারের কথায়ই আমরা ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনে গিয়েছি। এ কারণে এখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে, কিন্তু এখন সরকার ক্যাপটিভকে উৎসাহ দিচ্ছে না, এটা হয়তো যৌক্তিক। কিন্তু একবারে গ্যাসের মূল্যহার অসম্ভব পর্যায়ে নিয়ে গেলে সেটার চাপ সহ্য করা সম্ভব হবে না। এভাবে শিল্পগুলোর জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। শুধু রফতানিমুখী নয়, বরং স্থানীয় শিল্পগুলোর জন্যও কঠিন হবে। সব শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়ের ক্ষেত্র বিদ্যুৎ, সরকারের তরফ থেকেও প্রতিশ্রুতি ছিল যে সহনীয় পর্যায়ে এর দাম বাড়বে। কিন্তু এখন মূল্যবৃদ্ধির হারে যে ধরনের উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, তা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের পরিস্থিতি অনুধাবন করবে। কারণ বিশ্বব্যাপী আমরা শিল্পবান্ধব বলে পরিচিত হয়ে উঠেছি। এ পরিচয় ধরে রাখতে হবে।

জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিরুল হক বলেন, শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নে আমাদের এখন বেশি মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। কিন্তু এটা করা যাচ্ছে না ব্যবসার আনুষঙ্গিক ব্যয়বৃদ্ধির কারণে। এ মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়লে পণ্য উৎপাদন খরচ আরো বেড়ে যাবে।

ফলে ২০২৫ সালে আমরা দুই অংকের প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি, তা ব্যাহত হতে পারে। অর্থনীতি যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে এ মুহূর্তে কোনো একটি খরচ বাড়াতে গিয়ে যদি ছন্দপতন হয়, তাহলে অনেক অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে।

গ্যাসের দাম বাড়লে ব্যবসার খরচ বাড়বে ইস্পাত খাতেও। এ খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়লে রডের দাম টনপ্রতি ২০০-২২৫ টাকা বাড়তে পারে।

দেশে ইস্পাত খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হোসেন আকবর আলী বলেন, আমার মনে হয়, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে সবকিছুতে। ব্যবসার খরচ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুভাবে বাড়বে। রফতানি খাতে উৎপাদন খরচ বাড়বে, ইস্পাত খাতেও বাড়বে। কিন্তু উপায় নেই। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে দামে কিনি, তা স্থানীয় বাজারে সমন্বয় করতেই হবে। বাস্তবতা থেকে আমরা পালাতে পারব না।

দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত তৈরি পোশাক। প্রতি বছরই ৫ শতাংশ হারে শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে এ খাতের। সর্বশেষ গত বছর ডিসেম্বরে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে নতুন মজুরি কাঠামো। পোশাক তৈরিতে শ্রমের মজুরির সঙ্গে বেড়েছে ব্যাংকঋণের সুদও। নতুন করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এ খাতের ব্যবসার খরচ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দাবি, ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত পোশাকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ব্যাংকঋণের সুদহার কমেনি। আগে অফশোর লোন নেয়া যেত, এখন তাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কথা শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তে শুধু পোশাক নয়, সব শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে যাবে।

বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি, সার্বিক খরচ মিটিয়ে ব্যবসা পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যেও অনেক সময় পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক শিল্প-কারখানায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাদের ব্যাংকঋণের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধে।

নতুন করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসার খরচ আরো বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীরা শুধু চাপের মুখে নয়, গভীর সংকটে পড়বেন বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, এতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যখন-তখন জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে।

এতে ব্যবসার খরচ নিয়ে কোনো ধারণা করা যাচ্ছে না। আমাদের প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির স্বল্পমেয়াদি ধারণা পাওয়াই জটিল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা যায় না। একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে সমস্যা কোথায়, তাও বোধগম্য নয়। ব্যাংকের টাকা নিয়ে ব্যবসা করলেও কতদিনে তা পরিশোধ করা যাবে, সে ব্যাপারে কোনো ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *