পাঁচ মাসে বোয়িংয়ের দুই উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
পাঁচ মাসে দুটি বড় দুর্ঘটনা। শতাধিক উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড। নিরাপত্তা নিয়ে এ দুর্ভাবনা বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ নিয়ে। এ মডেলের উড়োজাহাজ দিয়ে অনিয়মিত হলেও বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করছে মালিন্দো ও জেট এয়ার এবং স্পাইস জেট।
আগামী বছরের মার্চ নাগাদ বহরে বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ সংযোজনের ঘোষণা দিয়েছে দেশের বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস-বাংলাও। যদিও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বলছে, ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আগে দেশের কোনো এয়ারলাইনসকে এ মডেলের উড়োজাহাজ ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হবে না।
লায়ন এয়ারের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পাঁচ মাসের মধ্যে গত রোববার বিধ্বস্ত হয় ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের একই মডেলের ‘বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স’ উড়োজাহাজ। দুটি উড়োজাহাজই বিধ্বস্ত হয় উড্ডয়নের ১৫ মিনিটের মধ্যে। পাঁচ মাসের মধ্যে দুটি দুর্ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ।
নিরাপত্তার কারণে ৭ মার্চই বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের ১৪টি উড়োজাহাজ ব্যবহার না করার ঘোষণা দেয় আমেরিকান এয়ারলাইনস। রোববারের দুর্ঘটনার পর চীন সরকার এ মডেলের ৯৭টি উড়োজাহাজ বিমানবন্দরে গ্রাউন্ডেড রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
এয়ার চায়না, চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনস ও চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের বহরে রয়েছে উড়োজাহাজগুলো। নিজেদের বহরে থাকা বোয়িংয়ের একই মডেলের সব উড়োজাহাজের ফ্লাইট বন্ধ করেছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসও। বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্সের বিষয়ে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছে ফিজি এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস ও ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ। ভারতের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষও বোয়িংয়ের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চেয়েছে।
দেশটির স্পাইস জেট ও জেট এয়ারওয়েজের বহরে এ মডেলের উড়োজাহাজ রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় এয়ারলাইনস কোরিয়ান এয়ার তাদের বহরে বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স যুক্ত না করার কথা জানিয়েছে। বোয়িংয়ের কাছ থেকে এ মডেলের ৫০টি উড়োজাহাজ ক্রয়ে ২০১৫ সালে চুক্তি করে কোরিয়ান এয়ার।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে মালিন্দো এয়ার। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের জেট এয়ারওয়েজ ও স্পাইস জেট বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ ব্যবহার করে ঢাকায় ফ্লাইট পরিচালনা করলেও সেটি নিয়মিত নয়।
আর দেশী এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস ২০২০ সালের মার্চ নাগাদ তাদের বহরে বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক এয়ারক্রাফট লিজিং কোম্পানি এয়ারক্যাপ, বোয়িং কোম্পানি ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস গত মাসে যৌথভাবে এ ঘোষণা দেয়।
তবে বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পর বিষয়টিতে নজর রাখছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস ও লায়ন এয়ারের ম্যাক্স উড়োজাহাজের দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো এয়ারলাইনসকে এ মডেলের উড়োজাহাজ কেনা বা লিজের অনুমতি দেবে না বেবিচক।
বেবিচক পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশনস) উইং কমান্ডার চৌধুরী এম জিয়াউল কবির বণিক বার্তাকে বলেন, বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স ৮ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার বিষয়টিতে আমরা নজর রাখছি। বাংলাদেশী কোনো এয়ারলাইনস এখন পর্যন্ত ম্যাক্স ক্রয় বা লিজের অনুমতি চায়নি।
তবে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার আগে ম্যাক্স ক্রয় বা লিজের অনুমতি দেয়া হবে না। তদন্ত প্রতিবেদনে উড়োজাহাজটির কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে বাংলাদেশে ম্যাক্স ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হবে না।
উড়োজাহাজের ডিজাইন বা টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, এটা প্রমাণ হলে ম্যাক্সের ডেলিভারি নেয়া হবে না বলে জানিয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ। এয়ারলাইনসটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ বণিক বার্তাকে বলেন, ম্যাক্স ডেলিভারি পেতে এখনো এক বছর বাকি আছে।
এ সময়ের মধ্যে যদি তদন্তে উঠে আসে উড়োজাহাজের ডিজাইন বা টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাহলে আমরা এ ডেলিভারি গ্রহণ করব না। এয়ারক্যাপও ডেলিভারির সময়ের মধ্যে এসব ত্রুটি সম্পূর্ণরূপে দূর করা না হলে উড়োজাহাজের ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে না।
বোয়িংয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বর্তমানে ৩০০-এর বেশি ৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের উড়োজাহাজ ব্যবহার করছে বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইনসগুলো। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত আরো পাঁচ হাজার উড়োজাহাজের ক্রয়াদেশ আছে।
বোয়িংয়ের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে দ্রুত বিক্রি হতে থাকা উড়োজাহাজ। ইথিওপিয়ার দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী করণীয় ঠিক করার ঘোষণা দিয়েছে বোয়িং। তার আগেই অনেক এয়ারলাইনস এরই মধ্যে এ মডেলের উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড করেছে।
চীনের সিভিল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গতকাল এক বিবৃতিতে জানায়, সম্প্রতি বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের যে দুটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে, এর একটি ছিল নতুন। এছাড়া দুটি উড়োজাহাজই উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তাই এ মডেল নিয়ে তারা একটু উদ্বিগ্ন।
এ মডেলের উড়োজাহাজগুলো আপাতত উড়বে না। নির্মাতা কোম্পানি বোয়িং ও মার্কিন ফেডারেল এভিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তারা উড়োজাহাজগুলোর ‘ফ্লাইট নিরাপত্তা’ দিলেই আবার সেগুলো উড়বে। এমন একটি সতর্কতার জন্যই এ উদ্যোগ।
গত অক্টোবরে লায়ন এয়ারের ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরই এর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তদন্তকারীরা সে সময় জানিয়েছিলেন, উড়োজাহাজকে সচল রাখতে ৭৩৭ ম্যাক্সে সংযোজিত নতুন একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির (অ্যান্টি-স্টলিং সিস্টেম) সঙ্গে মানিয়ে নিতে বৈমানিক সংগ্রাম করছিলেন বলে মনে হয়েছে।
তদন্তে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা গেছে, উড়োজাহাজটি যেন স্থবির হয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে নকশা করে সংযোজিত এ পদ্ধতিটি উড়োজাহাজের নাকটিকে বারবার নিচের দিকে নামিয়ে দিচ্ছিল, যদিও বৈমানিক তা ঠিক রাখার চেষ্টা করছিলেন।
একই ঘটনা ঘটে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের ক্ষেত্রেও। দুর্ঘটনার পর এয়ারলাইনসটির প্রধান নির্বাহী সাংবাদিকদের বলেন, উড্ডয়নের পর পরই বৈমানিক সমস্যা বোধ করছেন বলে জানিয়ে ফিরে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। তাকে ফিরে আসার অনুমতিও দেয়া হয়েছিল।
নতুন একটি মডেলের উড়োজাহাজ পাঁচ মাসের ব্যবধানে দুবার বিধ্বস্ত হওয়াকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন বিভাগের সাবেক মহাপরিদর্শক ম্যারি স্কিয়াভো। সিএনএনকে তিনি বলেন, উড়োজাহাজ পরিবহন শিল্পে এটি সতর্ক সংকেত বাজিয়ে দিয়েছে। কারণ এমনটি ঘটে না।
যদিও বোয়িং-৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের উড়োজাহাজটি ২০১৭ সাল থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত এয়ারলাইনস তাদের বহরে যুক্ত করতে শুরু করে। ৭৩৭ ম্যাক্স এয়ারক্রাফটে সংযুক্ত অত্যাধুনিক কেবিন ডিজাইন ও ইন-ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেম বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন গন্তব্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তুলনামূলক কম খরচ, পরিবেশবান্ধব ও সময়ের কারণে বিশ্বব্যাপী এয়ারালাইনস কোম্পানির কাছে মডেলটি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।