ফল ক্রয় বিক্রয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল
বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় ফলের আধিক্য রয়েছে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে ফলমূলের স্বল্পতাও রয়েছে। প্রাকৃতিক এই বণ্টনের কারণেই বিভিন্ন এলাকা ও দেশের ব্যবসায়ীরা অন্যত্র থেকে ফলমূল ও শাকসবজি ক্রয়-বিক্রয়ে বাধ্য হয়ে থাকেন।
ফল ব্যবসার কিছু পদ্ধতি শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ নয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো কিছু ব্যবসায়ী না জানার কারণে সেসব পদ্ধতিতে ব্যবসা করে চলেছেন। আবার কোনো কোনো ব্যবসায়ী এত সতর্কতা অবলম্বন করছেন, ব্যবসার বৈধ পদ্ধতিগুলোকেও অবৈধ মনে করে সেগুলো বর্জন করে চলেছেন।
এজন্য আমরা ফল ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধ ও অবৈধ পদ্ধতিগুলোর সারসংক্ষেপ পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। এতে ব্যবসায়ীরা শরয়ি সীমারেখার ভেতরে থেকে এ লাভজনক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারবেন।
বাগানে থাকা অবস্থায় ফলমূলের ক্রয়-বিক্রয় বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে হয়ে থাকে। সেগুলোর অধিকাংশ পদ্ধতি বৈধ হলেও কোনো কোনো পদ্ধতি বৈধ নয়। আমি ফল ব্যবসার পদ্ধতিগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করছি :
১. যেসব ফল গাছে একসঙ্গে ধরে, যতদিন পর্যন্ত সেগুলো ফুলের আকৃতি ধারণ না করবে ততদিন পর্যন্ত সেগুলোর ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। কেননা এ অবস্থায় যে বস্তুকে বিক্রয় করা হচ্ছে বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। আর শরয়ি দৃষ্টিকোণে অস্তিত্বহীন বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ নেই।
আজকাল বিভিন্ন গাছ ও বাগ-বাগিচা কয়েক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আগামী কয়েক বছরের ফলমূল তাৎক্ষণিকভাবে বিক্রয় করে দেওয়া হয়। এ চুক্তিতে যেহেতু একটি অস্তিত্বহীন বস্তুকে বিক্রয় করা হয়, এজন্য এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। নিম্নোক্ত শর্তগুলো পাওয়া গেলেই কেবল বাকিতে ফলমূল বিক্রয় করা জায়েজ :
* বিক্রয়ের সময় থেকে নিয়ে ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করার আগ পর্যন্ত বিক্রেতার কাছে বিক্রয়কৃত ফল বিদ্যমান থাকতে হবে।
* বিক্রয়ের মজলিস সমাপ্ত হওয়ার আগেই ফলের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
* গুণ ও মানের ভিত্তিতে ফল নির্ধারণ করা সম্ভব হতে হবে।
* ফলের প্রকার জানা থাকতে হবে।
* এর পরিমাণ জানা থাকতে হবে।
* গুণ ও মান জানা থাকতে হবে।
* হস্তান্তরের সময়সীমা নির্ধারিত হতে হবে।
* হস্তান্তরের স্থান নির্ধারিত হতে হবে।
২. গাছে ফল প্রকাশ পাওয়ার পর যদি অবস্থা এমন হয় যে, তাকে মানুষের প্রয়োজনেও ব্যবহার করা যায় না এবং পশুদেরও খাওয়ানো যায় না, তা হলেও এর ক্রয়-বিক্রয় বৈধ। কেননা বর্তমানে যদিও এটি একটি অনুপকারী বস্তু কিন্তু কিছুদিন পর এটি উপকারী হতে পারে। আর শরিয়তের মূলনীতি হলো, যে বস্তু বর্তমানে বা ভবিষ্যতে উপকারী হতে পারে তার ক্রয়-বিক্রয় বৈধ।
৩. গাছে যদি ফুল ধরে বা ফল এমন হয় যে, তার ব্যবহার উপকারী হতে পারে, এরপর একে তাৎক্ষণিকভাবে গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে যাওয়ার শর্তে বিক্রয় করা হয় অথবা কোনো শর্ত ছাড়াই বিক্রয় করা হয়, তা হলে এমন ক্রয়-বিক্রয়ও জায়েজ। ফুলের এই ক্রয়-বিক্রয় এজন্য জায়েজ যে, এগুলো পশুদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
৪. গাছে যদি ফল ধরে কিন্তু তা খাওয়ার উপযোগী না হয় এবং ক্রেতা কোনো শর্ত ছাড়াই ক্রয় করে নেন, তা হলে এ ক্রয়-বিক্রয়ও বৈধ। আর বিক্রয়ের সময় যদি এ চুক্তি হয়, ক্রেতা সঙ্গে সঙ্গে ফল পেড়ে নিয়ে যাবেন, আর মালিক চুক্তি করার সময়ই ফল পাড়তে বলেন, তা হলে ক্রেতার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ফল পেড়ে গাছ খালি করে দেওয়া আবশ্যক!
৫. গাছে ফল ধরার পর যদি খাবার উপযুক্ত না হয় এবং ক্রেতা ক্রয় করার সময় কোনো শর্ত আরোপ না করেন, বরং স্বয়ং মালিক তাকে অনুমতি দিয়ে দেন, আপনি কিছুদিনের জন্য এ ফলগুলো আমার গাছে রাখতে পারেন, তা হলে এ পদ্ধতিটিও বৈধ।
৬. যদি ফল খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায় এবং বিক্রয়ের সময় এ চুক্তি হয়, ক্রেতা তাৎক্ষণিকভাবে গাছ থেকে ফল পেড়ে নিয়ে যাবেন, এরপর ক্রেতা মালিকের অনুমতি ছাড়া কিছুদিনের জন্য তার গাছে ফল রেখে দেন, তা হলে এ সময়ের মধ্যে যেহেতু ফলগুলোয় কোনো বর্ধন ঘটেনি, তাই ক্রেতা ফলগুলোর মালিক হবেন। অবশ্য মালিকের অনুমতি ছাড়া গাছ ব্যবহার করার কারণে ক্রেতা গুনাহগার হবেন।
৭. যদি ফল প্রস্তুত হয়ে যায় এবং ক্রেতা এই শর্তে ক্রয় করেন, তিনি ফলগুলো গাছে রাখবেন না, অথবা কোনো শর্ত ছাড়াই ক্রয় করেন, তা হলে এ দুই পদ্ধতিও জায়েজ।
৮. যদি ফল প্রস্তুত হয়ে যায় এবং ক্রেতা এ শর্তে ক্রয় করেন, তিনি ফলগুলো গাছেই রেখে দেবেন, তা হলে শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে এর অনুমতি রয়েছে।
৯. যদি একটি বাগানে বিভিন্ন ধরনের ফল তথা আপেল, জাম ও আমের গাছ থাকে এবং ক্রয় করার সময় কোনো কোনো গাছে ফল ধরে এবং কোনো কোনো গাছে ফুলও না ধরে এবং ক্রেতা একই চুক্তিতে বিদ্যমান ও অবিদ্যমান সব ফল ক্রয় করে নেন, তা হলে এটাও বৈধ। এ অবস্থায় অবিদ্যমান ফলগুলো বিদ্যমান ফলগুলোর অনুগামী হয়ে ক্রেতার মালিকানায় চলে আসবে।
১০. যদি গাছগুলোয় কিছু ফল ধরে এবং কিছু ফল পরবর্তী সময়ে ধরার সম্ভাবনা থাকে এবং ক্রেতা সব একসঙ্গে ক্রয় করে নেন, তা হলে এ পদ্ধতিও বৈধ। এ অবস্থায় অবিদ্যমান ফলগুলো বিদ্যমান ফলগুলোর অনুগামী হয়ে ক্রেতার করায়ত্তে চলে আসবে।
১১. গাছে ফল ধরার পর যদি তা খাওয়ার উপযোগী না হয় এবং ক্রেতা বিদ্যমান ফলগুলো ক্রয় করে নেন, এরপর মালিকের অনুমতিক্রমে কিছুদিনের জন্য ফলগুলো গাছে রেখে দেন, তা হলে তা বৈধ। এ সময়ে বিদ্যমান ফলগুলোয় যে বর্ধন ঘটবে তা ক্রেতার বলে গণ্য হবে। আর ক্রয় করার সময় যদি এ চুক্তি হয়, গাছ থেকে ফল তাৎক্ষণিকভাবে পেড়ে নিয়ে যেতে হবে, কিন্তু ক্রেতা মালিকের অনুমতি ছাড়াই ফলগুলো গাছে রেখে দেন; আর এ সময়ে নতুন কিছু ফল ধরে, তা হলে বাড়তি ফলগুলো গ্রহণ করা ক্রেতার জন্য বৈধ হবে না। তার জন্য জরুরি হলো যত পরিমাণ ফল বেড়েছে তার সমপরিমাণ টাকা অনুমান করে সদকা করে দেওয়া।
১২. গাছে যদি কিছু ফল ধরে আর ক্রেতা কেবল বিদ্যমান ফলগুলোই ক্রয় করেন, এরপর ক্রয়কৃত ফলগুলো হস্তগত করার আগেই আরও কিছু ফল ধরে, তা হলে ক্রয়-বিক্রয়ের প্রথম চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাবে। কেননা ক্রয়কৃত ফলগুলোয় বর্ধন ঘটেছে। এ বর্ধিত ফলগুলো গাছের মালিকের। এখন ক্রেতা ও বিক্রেতার ফলগুলো আলাদা করা অনেক কঠিন ব্যাপার।
১৩. গাছে যদি কিছু ফল ধরে এবং ক্রেতা কেবল বিদ্যমান ফলগুলোই ক্রয় করেন এরপর ক্রয়কৃত ফলগুলো গ্রহণ করার পর যদি গাছে আরও অতিরিক্ত কিছু ফল ধরে, তা হলে পরবর্তী সময়ে ধরা ফলগুলোয় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের মালিকানার পরিমাণ ক্রেতার বর্ণনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে।
১৪. যদি গাছে ফল ধরে কিন্তু খাবার উপযোগী না হয় এবং ক্রেতা এ শর্তে ক্রয় করে, ফল এতদিন পর্যন্ত গাছেই থাকবে, তা হলে এ পদ্ধতিও জায়েজ।
তথ্যসূত্র : সাপ্তাহিক শরিয়া অ্যান্ড বিজনেস; আলহিদায়া; বুহুস ফি কাজায়া ফিকহিয়্যা মুআসারা; ফিকহি মাকালাত।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া দারুল উলুম নুরিয়া মধ্যবাড্ডা, গুলশান, ঢাকা।