কৃষকের লোকসান কমছে

পরপর তিনটি ফসলের মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন। কম দামে বিদেশ থেকে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারি গুদামে সবচেয়ে বেশি চালের মজুত। তারপরেও ধান-চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে দুই টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর ধানের দাম প্রতি মণে বেড়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা।

অবশ্য সরকারি হিসাব বলছে, চালের দাম কমেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে এক থেকে দুই টাকা কমেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গত ৭ জানুয়ারির দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, মোটা চালের দাম কেজিতে এক টাকা করে কমেছে। আর দেশের চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির হিসাবে, সব ধরনের ধানের দাম প্রতি মণে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে কৃষকের লোকসান কমে আসছে।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ধান–চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে উদ্বেগও জানিয়েছেন। দাম নিয়ে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার চালকলের মালিকদের সঙ্গে নতুন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি খাদ্যভবনে আলোচনায় বসছেন।

জানতে চাইলে বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গত রাতে মুঠোফোনে বলেন, এবার আমনে বাম্পার ফসল হয়েছে। মজুতও যথেষ্ট পরিমাণে ভালো। তাহলে দাম কেন বাড়বে এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এর মধ্যে অন্য কোনো ব্যাপার থাকতে পারে। তাঁরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।

চালের দাম পর্যবেক্ষণ করে গবেষক ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ধান-চালের দাম এখন পর্যন্ত কৃষকের উৎপাদনের খরচের প্রায় সমান সমান আছে। ছয় মাস ধরে ধান-চালের দাম ক্রমাগতভাবে নিচে নামছিল। অবশ্য এক সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতি পাল্টেছে। দাম আবার বাড়ছে।

চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ধান-চালের দাম বেড়ে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাঁদের হিসাবে, চলতি বছর প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৩৮ টাকা। আর সরকার সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করেছে ৩৬ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা। সেই হিসাবে কৃষকেরা বর্তমানে লোকসান কমে আসছে। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দামও কিছুটা বেড়েছে উল্লেখ করে তাঁরা বলছেন, কৃষকের লোকসান যাতে না হয়, সে জন্য চালের দাম ৪০ টাকার ওপরে যাওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নতুন দায়িত্ব নেওয়া খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘আমি মাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি আগে আমি ভালোমতো বুঝি। তারপর এ নিয়ে কথা বলব। তবে সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে আমি কাজ করব। তাতে যেকোনো সমস্যাই মোকাবিলা করতে পারব বলে আমি আশা করি।’

চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা মূলত তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমত গত জুনে সরকার চালের আমদানি শুল্ক ২ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশ করে। এতে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাজারে চালের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত সরকার আমনের সংগ্রহ শুরু করায় বিভিন্ন হাটে পাইকারি বিক্রেতারা ধান কিনতে শুরু করেছেন। এতে দাম বেড়েছে। তৃতীয়ত, নির্বাচন ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে হাটে ধানের জোগান কমে গেছে। ফলে দাম কিছুটা বেড়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী  বলেন, কৃষককে যদি চাল বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়, তাহলে তাঁকে অবশ্যই প্রতি মণ চালে কমপক্ষে ১০০ টাকা মুনাফা দেওয়া উচিত। এ জন্য ধান-চালের দাম আরও বাড়ানো উচিত বলে তিনি মনে করেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৯০ লাখ টন এবং আমনে ১ কোটি ৩৫ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। যা এর আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর হিসাবে, গত অর্থবছরে বিশ্বের যে কটি দেশে চালের উৎপাদন বেশি হারে বেড়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১৭ সালের মে মাসে হাওরে অকালবন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার কারণে চালের দাম বেড়ে যায়। তখন সরকার চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে নিয়ে আসে। কিন্তু এতে চালের আমদানি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বেড়ে গেলে সরকার গত জুনে আবারও শুল্ক ২৮ শতাংশ করে।

দেশের ধান-চালের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী বলেন, চালের দাম বাড়লে গণমাধ্যম ও মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে যায়। এটা ঠিক নয়। কারণ, বাজারে এখন ধান-চালের যা দাম, তাতে কৃষকের লোকসান হচ্ছে। কৃষকের স্বার্থে এই দাম আরও বাড়া উচিত। তবে দাম যাতে খুব বেশি না বাড়ে, সেই দিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ দাম যাতে নিশ্চিত হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। নতুন মন্ত্রীর জন্য এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *