বাড়তি ভ্যাটে দাম বাড়বে রমজানে

স্টাফ রিপোর্টার

বছরের পর বছর যেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সেভাবে বাড়ছে না আয়। ফলে আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে না পেরে বিপাকে দেশবাসী। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে জীবন চালাতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে সংসারের সব খরচ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় মাসে কিছুটা কমেছে মূল্যস্ফীতি। তবে তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নয়। এরই মধ্যে নতুন করে বিস্কুট, জুস, কোমলপানীয়, পোশাক, বিদেশি ফলসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় আরোপ করা হয়েছে বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক। এরই মধ্যে কিছু পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। বাকিগুলোতেও দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে মার্চ থেকে শুরু হওয়া রমজানে বাড়তি ভোগান্তিতে পড়বে সাধারণ মানুষ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাড়তি ভ্যাটের কারণে রমজান মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। তবে সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে পারলে লাগাম টেনে ধরা সম্ভব।

বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। খাদ্য খাতে ১৪ দশমিক ১০ ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট শপথ নিয়েছিল অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার।

পরে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। যদিও খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৬ এবং খাদ্যবহির্ভূত খাতে কমে হয় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পরের মাস সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ, অক্টোবরে ১০ দশমিক ৮৭, নভেম্বর মাসে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ ও ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে।

সর্বশেষ ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়। এ মাসে খাদ্য খাতে ১০ দশমিক ৭২ ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায়। বর্তমানে সবজিসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম কম। তবে বাড়তি ভ্যাটের কারণে ফের বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম।

১৯৭৩ সাল থেকে মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে বিবিএস। ১২৭টি খাদ্যপণ্য এবং ২৫৬টি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য থেকে মূল্যস্ফীতির তথ্য বের করা হয়। খাদ্যপণ্যের আবার ২৪২টি ভ্যারাইটি আছে। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের আছে ২৫৬টি ভ্যারাইটি। দেশের ১৫৪টি বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৬৪টি জেলা থেকে নেওয়া হয় তথ্য। এর পাশাপাশি ঢাকার ১২টি ও চট্টগ্রামের চারটি বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অন্যান্য বিভাগের ১৮টি স্থান থেকে তথ্য নেওয়া হয়। আটটি বিভাগ বাদে ৫৬টি জেলা শহর থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির বিষয়টি খুবই কাছ থেকে দেখে বিবিএস।

বিবিএস বলছে, সাপ্লাই চেইন যত মসৃণ হবে ততই মূল্যস্ফীতি কমবে। পাশাপাশি হাত যত কম বদল হয়ে ভোক্তার হাতে আসবে ততই ক্রেতা ও উৎপাদকের জন্য মঙ্গল। যদিও মূল্যস্ফীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে সেটি তাদের দায়িত্বের আওতায় নেই।

মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাজ মাঠ থেকে ডাটা সংগ্রহ করে প্রকাশ করা। মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে কিছুটা কমছে। তবে এটা আরও বেশি কমতে পারে যদি সাপ্লাই চেইন ঠিক থাকে। ফসলের মাঠ থেকে এটা অসংখ্যবার হাতবদল হয়ে ক্রেতার কাছে আসে। হাতবদল কমলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতো। তবে মূল্যস্ফীতি কেন কমছে, কেন কমছে না এটা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ সারাদেশ থেকে পণ্যের দাম ও তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করা।’

সরকারের নানান উদ্যোগে কিছুটা স্বস্তি মিলেছিল মূল্যস্ফীতিতে। তবে বাড়তি ভ্যাটের কারণে ফের নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

রমজান উপলক্ষে এরই মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ছোলা, মটর ও মসুর ডাল আমদানি হয়েছে। এছাড়া গত বছরের অনেক পণ্য গুদামে অবিক্রীত থেকে গেছে। সব মিলিয়ে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের সংকট থাকবে না।
রমজানে সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘এমন সময় কর বাড়ানো হলো যখন আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির রেজিমে আছি। আমাদের বাজারব্যবস্থাও ঘোলাটে। কখন কোনটার দাম বাড়ে ঠিক নেই। কোনো কারণ ছাড়াই পণ্যের দাম বাড়ছে। কিছুতেই কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। বর্তমানে বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে তাদের হাতে বা কিছু স্বার্থবাজের দখলে চলে গেছে। যারা নিজের স্বার্থে এই বাজারটা ব্যবহার করে।’

ড. মুজেরী আরও বলেন, “যখন এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়লো তখন দেখা যাবে বাজারে পণ্যের দাম বাড়া শুরু হয়ে গেছে। কাজেই আমার ধারণা আগামীতে পণ্যের দাম বাড়তে থাকবে। সামনে রমজান মাসে কিন্তু আরও বাড়বে পণ্যের দাম। যে পণ্যের ওপর করহার বাড়ানো হয়েছে শুধু সেই পণ্যে মূল্যবৃদ্ধি সীমাবদ্ধ থাকবে না। অন্য পণ্যের দামও বাড়বে। এমন একটা সময়ে দাম বাড়ানো হলো যখন খুব একটা সুফল আসবে বলে আমার মনে হয় না। মূল্যস্ফীতিতে নিম্ন আয়, দরিদ্র, এমনকি মধ্যবিত্তেরও নাভিশ্বাস অবস্থা। এমন একটা পরিস্থিতিকে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মনে হয়। সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আরও দুরূহ হয়ে পড়বে।”

দাম বাড়ার শঙ্কা রমজানে
রমজান উপলক্ষে এরই মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ছোলা, মটর ও মসুর ডাল আমদানি হয়েছে। এছাড়া গত বছরের অনেক পণ্য গুদামে অবিক্রীত থেকে গেছে। সব মিলিয়ে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের সংকট থাকবে না। তবে সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকলে রমজানে দাম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রমজানে আশা করছি দাম সহনশীল পর্যায়ে থাকবে। সাপ্লাই ঠিক থাকলে প্রভাব পড়বে না। রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। তারপরও রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে, এ আশঙ্কা থাকবে। এটা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে সরবরাহ ও প্রতিযোগিতা ঠিক থাকলে এটা হবে না।’

রমজানে ব্যবসায়ীরা কারসাজির সুযোগ নেন। সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকলে দাম বাড়ানো প্রতিহত করা যাবে জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান  বলেন, ‘সরকার ভ্যাট বাড়িয়েছে। এর প্রভাব রমজানে থাকবে। তবে সাপ্লাই বেশি থাকলে মূল্যেও প্রভাব পড়ে। রমজানে ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধি করতে চান। কারণ রমজান মাসে কিছু পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি থাকে, ব্যবসায়ীরা এটার সুযোগ নেন। রোজায় বেশি চাহিদা হয় ডাল, খেজুর, পেঁয়াজ ও গমের। এগুলোর সরবরাহ ও আমদানি ভালো। ঠিকমতো সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থা তদারক করতে হবে। কারণ এসময় ব্যবসায়ীরা কারসাজির সুযোগ নেন। যদি বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করা যায় তবে এবার রমজানে মূল্যবৃদ্ধি হবে না। ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে সুযোগ নিতে পারবেন না।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, তবে যেগুলোর ওপর ভ্যাট বসেছে তার দাম বাড়বে। আমদানি সময় মতো করা, বাজারে পণ্যের প্রবেশগম্যতার সমস্যা যাতে না হয় বিষয়গুলো দেখতে হবে। এলসি খোলায় সমস্যা যাতে না হয়, সময় মতো ব্যবসায়ীরা যেন ক্রেডিট দিতে পারেন। তাহলে ব্যবসায়ীরা রমজানে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ালে তা প্রতিহত করা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *