‘জামানত নেই, কাজের অভিজ্ঞতা নেই, মোটা অঙ্কের ঋণ প্রস্তাব
এক সময়ের স্বনামধন্য বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে অব্যবস্থাপনা আর ঋণে অনিয়মের কারণে। এবার নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ প্রস্তাব করেছে ব্যাংকটি। যেখানে সঠিক ঠিকানা নেই কোম্পানির। যেসব কাজের কথা বলে আবেদন করা হয়েছে আদতে সে অভিজ্ঞতাও নেই প্রতিষ্ঠানটির। প্রস্তাবে রাখা হয়নি পর্যাপ্ত জামানতও। আবার প্রতিষ্ঠানটি অন্য একটি ব্যাংকের খেলাপি। মাত্র আট লাখ টাকা মূলধনি কোম্পানির নামে ১৫০ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব করা হয়।
আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ করে অর্থ পাচারের লক্ষ্য ছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ওই ঋণ বিতরণ বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে সতর্ক করা হয় এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে উঠে আসে, কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান এবি ব্যাংকের কাকরাইল ইসলামী ব্যাংকিং শাখার গ্রাহক। কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লোহা উৎপাদনের জন্য ঋণের আবেদন করলেও এক্ষেত্রে তাদের নেই পূর্ব অভিজ্ঞতা। কোম্পানির আবেদনে কোনো জামানত প্রস্তাব করা হয়নি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র আট লাখ টাকা। তবু কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেডকে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বেসরকারি খাতে প্রথম প্রজন্মের এবি ব্যাংক।
এবি ব্যাংক এবার নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ প্রস্তাব করেছে। সঠিক ঠিকানা নেই কোম্পানির। যেসব কাজের কথা বলে আবেদন করা হয়েছে আদতে সে অভিজ্ঞতাও নেই প্রতিষ্ঠানটির। প্রস্তাবে রাখা হয়নি পর্যাপ্ত জামানতও। আবার প্রতিষ্ঠানটি অন্য একটি ব্যাংকের খেলাপি। মাত্র আট লাখ টাকা মূলধনি কোম্পানির নামে ১৫০ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব করা হয়।
তবে ঋণ প্রস্তাবটি সন্দেহজনক হওয়ায় অনুমোদন থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সহায়ক জামানত প্রস্তাব না করায় এবি ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এ পরামর্শ দেন। তবে এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল প্রভাব খাটিয়ে নামসর্বস্ব অত্যন্ত দুর্বল এ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বোর্ডে তোলেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ঋণ অনুমোদন বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনের চিত্র বলছে, কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেড ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২৪ সালের মার্চে এবি ব্যাংকের কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংকিং শাখায় হিসাব খোলে। একই বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গত ২১ এপ্রিল ২৫০ কোটি টাকার পরোক্ষ (নন-ফান্ডেড) ঋণ সুবিধার জন্য আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি।
এ ঋণ অনুমোদনের জন্য কাকরাইল শাখা একই তারিখে কল রিপোর্ট ও তথ্যাদিসহ শাখার বাণিজ্য প্রধানের কাছে পাঠানো হয়। পরে তা সিদ্ধান্তের জন্য সিআরএম ডিভিশনে পাঠানো হয়। তবে ২৮ এপ্রিল শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের পরিদর্শন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের জন্য ২৫০ কোটি টাকার পরোক্ষ ঋণ সুবিধার ন্যায্যতা না হওয়ায় প্রকল্প ও আমদানি ব্যবসা পরিচালনার নিমিত্তে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা প্রদানের অনুরোধ করা হয়।
কিন্তু বিপুল অঙ্কের ঋণ সুবিধা প্রদানের অনুমোদন করা হলেও সেখানে কোনো জামানত প্রস্তাব করা হয়নি। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিগোচর হলে ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদন থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপরও প্রভাব খাটিয়ে এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঋণ প্রস্তাবনা পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এবি ব্যাংকের পর্যবেক্ষক জামাল উদ্দিন জানিয়ে দেন, প্রস্তাব করা এ ঋণটি ব্যাংক ও আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আবার যে প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ প্রস্তাব করা হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠানটি অন্য ব্যাংকের খেলাপি। লোহা উৎপাদনের কথা উল্লেখ করা হলেও সেই কাজে তাদের অভিজ্ঞতা নেই। এর মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন করে পুরো টাকাই পাচারের উদ্দেশ্য ছিল এমনটা মনে করেন আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা।
কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেডে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২৪ সালের মার্চে এবি ব্যাংকের কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংকিং শাখায় হিসাব খোলা হয়। একই বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গত ২১ এপ্রিল ২৫০ কোটি টাকার পরোক্ষ (নন-ফান্ডেড) ঋণ সুবিধার জন্য আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি।- বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন
ক্রেডিট মেমোয় উঠে আসে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হচ্ছেন কিরণ কুমার কর্মকার। ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট থেকে তিনি স্যানিটারি ব্যবসায় জড়িত। অন্য পরিচালক পলাশ চন্দ্র শীল বিজনেস অপারেশন ম্যানেজমেন্ট ও সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞ। প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন ১০ লাখ টাকা আর পরিশোধিত মূলধন মাত্র আট লাখ টাকা।
ইউসিবি ব্যাংকের মহাখালী শাখার পত্র মাধ্যমে গত বছরের ২৮ মার্চ মেসার্স কোয়ালিটি স্টিলের নাম ও মালিকানা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠে কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। নাম পরিবর্তনের আগে ইউসিবির এ শাখাটিতে কোয়ালিটি স্টিলের ঋণ ছিল ৬৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এখন পুরো দায় কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলসের। ইউসিবির মহাখালীর এ শাখায় সাড়ে ৬৭ কোটি ঋণের মধ্যে মেয়াদি ঋণ ৩৮.২৯ কোটি টাকা, টাইম লোন সাত কোটি টাকা, সিসি (হাইপো) ২০ কোটি টাকা এবং ব্যাংক গ্যারান্টি ০.২৮ কোটি টাকা।
এ ঋণের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গ্রাহকের মেয়াদি ঋণ হিসাবটিতে দুটি মাসিক কিস্তি ওভারডিউ রয়েছে। গত বছরের আগস্টের সিআইবি রিপোর্ট বলছে, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পলাশ চন্দ্র শীল ব্র্যাক ব্যাংকে দুই কোটি ৪৩ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি। যে ঋণ সমন্বয়ের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। উৎপাদন সক্ষমতা নিয়েও রয়েছে লুকোচুরি। প্রতিষ্ঠানটি কাগজপত্রে প্রতিদিন ২২০ মেট্রিক টন উৎপাদনের হিসাব দিলেও এ প্রতিষ্ঠান থেকে দিনে সর্বোচ্চ ৪০ মেট্রিক টন পণ্য উৎপাদন করা যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে আসে।
এ বিষয়ে সাবেক এমডি তারিক আফজালের মুঠোফোনে কল ও এসএমএস পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলেননি। তবে এসএমএসের মাধ্যমে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তার নম্বর পাঠিয়ে দেন তিনি। পুনরায় তাকে (সাবেক এমডি) ফোনকল করা হলেও রিসিভ করেননি।
‘এভাবে যে ঋণই অনুমোদন হোক না কেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেটার সঙ্গে জড়িত থাকবে। এটার প্রস্তাব করা হলে বোর্ড থেকে শুরু করে কর্তৃপক্ষ এটার দায় এড়াতে পারে না। এটা অনুমোদন হলে মোটা অঙ্কের টাকা হয়তো দেশ অথবা দেশের বাইরে পাচারের শঙ্কা ছিল এবং পাচারের শঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এবি ব্যাংকের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঋণটি আমার (এমডি দায়িত্বে) সময়ের না। ১৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন বা স্যাংশন হয়নি। তবে প্রস্তাব করা হয়েছিল। কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের ঋণের প্রস্তাব থেকে এই ঋণ দেওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছিল বোর্ড। আবার বোর্ড চাইলেই সব দিতে পারে না। সেন্ট্রাল ব্যাংক এটি দেখবে। প্রস্তাবটি অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হলে তারা পর্যবেক্ষণ দেয়। এ কারণে ঋণ আর অ্যাপ্রুভ হয়নি।’
অনিয়মের বিষয়ে কথা হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। জামানতবিহীন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ প্রস্তাব বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বড় অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে জামানত প্রস্তাব না করেই অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হলে শুধু ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি নয়, এখানে চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের দায় আছে। বিগত সময়ে এস আলমসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বেনামি বা জামানতবিহীন ঋণের অনুমোদনের মাধ্যমে পাচারের দৃষ্টান্ত ওঠে এসেছে।
এখানে কিন্তু যে ব্যক্তির নামে লোনটি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে তার তুলনায় যে ঋণ প্রস্তাব করেছেন তার (ব্যাংক কর্মকর্তা) এবং বোর্ডের সঙ্গে জড়িত বা জড়িত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এভাবে যে ঋণই অনুমোদন হোক না কেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেটার সঙ্গে জড়িত থাকবে, কারণ বড় অঙ্কের ঋণের অনুমোদন সেখান থেকে হয়। এটার প্রস্তাব করা হলে বোর্ড থেকে শুরু করে কর্তৃপক্ষ এটার দায় এড়াতে পারে না। এটা অনুমোদন হলে মোটা অঙ্কের টাকা হয়তো দেশ অথবা দেশের বাইরে পাচারের শঙ্কা ছিল এবং পাচারের শঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’