কভিড-পরবর্তী বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় বেশি ছুটছেন ধনীরা
কভিড-পরবর্তী বিশ্বের বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ স্থানান্তরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ। দেশগুলোর উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্মত শিক্ষা, নিরাপত্তা ও ব্যবসা পরিচালনায় শিথিল পরিস্থিতি ধনী ব্যক্তিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সুইস ব্যাংকিং গ্রুপ ইউবিএসের নতুন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। খবর দ্য ন্যাশনাল।
‘বিলিয়নেয়ার অ্যাম্বিশনস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন অনুসারে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) অতিধনী বা বিলিয়নেয়ারদের মোট সম্পদ ২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৭০ কোটি ডলারে। দেশটিতে বিলিয়নেয়ার একজন বেড়ে ১৮-তে উন্নীত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের পর থেকে বিশ্বজুড়ে ধনী ব্যক্তিরা আগের তুলনায় বেশি স্থানান্তরিত হচ্ছেন। গত চার বছরে ১৭৬ জন বিলিয়নেয়ার স্থানান্তরিত হয়েছেন, যারা সম্মিলিতভাবে ৪০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি সম্পদ স্থানান্তর করেছেন।
ইউবিএস গ্লোবাল ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের স্ট্র্যাটেজিক ক্লায়েন্ট বিভাগের প্রধান বেঞ্জামিন কভালি বলেন, ‘মহামারীর ধাক্কায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব বেড়েছে। একই সঙ্গে তরুণ সদস্য রয়েছে এমন পরিবারে মানসম্মত শিক্ষা ও নিরাপদ পরিবেশের চাহিদা বেড়েছে। অধিকাংশ বিলিয়নেয়ার ব্যবসায়ী হওয়ায় তারা এমন জায়গায় থাকতে চান যেখানে ব্যবসা পরিচালনা সহজ এবং আইনি কাঠামো তাদের সম্পদ স্থানান্তরে সহায়তা করে।’
সাম্প্রতিক বছরে বিভিন্ন ধরনের সুবিধার কারণে ‘করস্বর্গ’ হিসেবে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বিলিয়নেয়ারদের স্থানান্তরের হার বেড়েছে। বিশেষ করে ধনীদের জন্য ইউএইর দুবাই বা আবুধাবির মতো শহরগুলোর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ব্রিটিশ বিনিয়োগ অভিবাসন পরামর্শক সংস্থা হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ৬ হাজার ৭০০ জনের বেশি ধনী ইউএইতে স্থানান্তরিত হয়েছেন। দেশটির করমুক্ত পরিবেশ, উচ্চ মানের জীবনযাপন এবং দৃঢ় আর্থিক কাঠামো ধনী ব্যক্তিদের কাছে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে অবৈধ অর্থ পাচার হওয়ায় এ অঞ্চল নিয়ে অভিযোগও কম নয়।
২০১৫ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা ৫১ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৭৫৭ ডলার থেকে ২ হাজার ৬৮২ জনে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের সম্মিলিত সম্পদ ৬ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার থেকে বেড়ে ১৪ লাখ কোটি ডলার হয়েছে। তবে ২০২০ সালের পর থেকে এ প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ শতাংশে থেমে আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বছরে বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ গড়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। তবে ২০২০ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী গড় বৃদ্ধি থমকে গেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ভারতের মতো কিছু অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
সম্পদ বৃদ্ধির হিসেবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি উজ্জ্বল স্থান হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে ভারত। গত দশকে দেশটির বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ১২৩ শতাংশ বেড়ে ১৮৫ জনে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের সম্মিলিত সম্পদ ২৬৩ শতাংশ বেড়ে ৯০ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
অতিধনীদের সংখ্যা ও সম্পদ বৃদ্ধির তালিকায় নারীরা এগিয়ে রয়েছে। এক দশকে নারী বিলিয়নেয়ার ৮১ শতাংশ বেড়ে ১৯০ থেকে ৩৪৪ জনে পৌঁছেছে। তাদের বড় একটি অংশ নিজস্ব উদ্যোগে এ তালিকায় উঠে এসেছে। অন্যদিকে ৪৯ শতাংশ বেড়ে পুরুষ বিলিয়নেয়ার হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ জন। এক দশকে নারী বিলিয়নেয়ারের সম্পদ ১৫৩ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যেখানে পুরুষদের সম্পদ ১১৭ শতাংশ বেড়ে ১২ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ ক্রমে আরো কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ২০১৫ সালে যেখানে শীর্ষ ১০০ বিলিয়নেয়ারদের কাছে মোট বিলিয়নেয়ার সম্পদের ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল, ২০২৩ সালে তা বেড়ে ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। ইউবিএসের তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ ১০০ ধনীর সবচেয়ে বেশি বা ৪৩ শতাংশ বসবাস করেন উত্তর আমেরিকায়। এরপর পশ্চিম ইউরোপে ২১ শতাংশ, ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৫ শতাংশ ও চীনে ৮ শতাংশ।
শীর্ষ ১০০ ধনীদের প্রায় অর্ধেক ভোক্তা ও খুচরা এবং খনি ও ধাতব খাতে যুক্ত। এ দুই খাত ২৪ শতাংশ করে হিস্যা দখলে রেখেছে। এরপর প্রযুক্তি ও আর্থিক পরিষেবা খাতের হিস্যা ১৬ শতাংশ করে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ৭০ বছর বা তার বেশি বয়সী বিলিয়নেয়াররা আগামী ১৫ বছরে ৬ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ স্থানান্তর করবেন। এর বেশির ভাগ পাবে পরিবার, কিছু যাবে দাতব্য কাজে।
সম্পদ অর্জনের প্রবৃদ্ধিতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন ধনীরা। আগামী ১২ মাসে ভূরাজনৈতিক সংঘাতকে বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন তারা। অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বৈশ্বিক মন্দা, উচ্চ কর, ঋণ সংকট, আর্থিক বাজার সংকট ও প্রযুক্তিগত বিপর্যয়।