আফ্রিকায় বাণিজ্য বিস্তারে বিদেশী শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ছে

স্টাফ রিপোর্টার

তিন বছর পর অনুষ্ঠিত হয় এমন একটি সম্মেলনের অংশ হতে আগামী মাসে চীন যাচ্ছেন আফ্রিকার অনেক নেতা। শুধু চীন নয়, সম্প্রতি একাধিক সম্মেলনের আমন্ত্রণ পেয়েছেন তারা। আমন্ত্রণকারীর তালিকায় আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির মতো নেতারা। এছাড়া তুরস্ক, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকে বার্তা পেয়েছেন তারা।

আফ্রিকায় বাণিজ্য বিস্তারে বাকি বিশ্বের নজর নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস। এতে তুলে ধরা হয়েছে অঞ্চলটি ঘিরে বাকি বিশ্বের তৎপরতা। এ তৎপরতাকে সুবিধা হিসেবে কাজে লাগাতে দেশগুলো কতটা কৌশলী অবস্থানে আছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে দেখা যায়, অফ্রিকার প্রতি বাকি বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন আলাদা, একইভাবে আফ্রিকাও কাঠামোগতভাবে পিছিয়ে রয়েছে।

আফ্রিকায় ব্যাপক বিনিয়োগ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আলোচনায় ছিল চীন। ২০১৬ সালে মহাদেশটিতে বেইজিংয়ের ঋণ শীর্ষে পৌঁছে, যার পরিমাণ ২ হাজার ৮৪০ কোটি ডলার। তবে বোস্টন ইউনিভার্সিটির পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সাল দেয়া ঋণ ছিল অনেক কম, প্রায় ১০০ কোটি ডলার। চীনের মনোযোগে ঘাটতি দেখা গেলেও একই সময়ে রাশিয়া, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), তুরস্ক ও ব্রাজিলসহ আরো কিছু দেশের আগ্রহ বেড়েছে আফ্রিকায়।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সংঘাত সারা বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতিতে মনোযোগের শীর্ষে রয়েছে। সে হিসেবে কূটনৈতিক দিক থেকে আফ্রিকা এজেন্ডার শীর্ষে নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মহাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা, মূল্যবান খনিজের বাহুল্য ও জাতিসংঘে ৫৪ ভোটের কারণে আফ্রিকা নিয়ে অনেক দেশ নতুন করে ভাবছে।

আফ্রিকা নিয়ে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ নিয়ে চিন্তিত বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসির অধ্যাপক চিদি ওডিনকালু। কারণ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে আফ্রিকার দরকষাকষির সুযোগ এখনো সীমিত। দেশগুলোকে আলাদা করে না দেখে আফ্রিকাকে একক অঞ্চল হিসেবে ভাবা হচ্ছে।

তাত্ত্বিকভাবে ‘কূটনৈতিক বহুকেন্দ্রিকতা’ বলে অভিহিত করে চিদি ওডিনকালু আরো জানান, আফ্রিকা বিদেশীদের এ আগ্রহের সুবিধা নিতে প্রস্তুত নয়। কারণ মহাদেশটি এখনো উন্নত শিল্পের পরিবর্তে প্রাথমিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ ধরে রেখেছে।

সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি সাব-সাহারান আফ্রিকায় জিডিপি হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৮১ সালের ১৮ শতাংশ থেকে গত বছর জিডিপি ১১ শতাংশে নেমে এসেছে।

বেশির ভাগ আফ্রিকান দেশ এখনো ঔপনিবেশিক ধাঁচে বাণিজ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। তারা কাঁচামাল রফতানির বিপরীতে বিদেশে তৈরি পণ্য আমদানি করে। একে ‘সুযোগ হারানোর গল্প’ বলে অভিহিত করেন চিদি ওডিনকালু।

তবে আফ্রিকার বাণিজ্য এখন নানা দিকে সম্প্রসারিত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনের পর মহাদেশটির সঙ্গে তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে উঠেছে ভারত। আফ্রিকার সঙ্গে ইউএইর বাণিজ্য গত ২০ বছরে প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে; এসব বাণিজ্যের বেশির ভাগই হীরা ও স্বর্ণকেন্দ্রিক।

তবে আফ্রিকার অর্থনৈতিক কাঠামো সমস্যাজনক বলে জানান কেনিয়ার রাজনৈতিক ভাষ্যকার প্যাট্রিক গাথারা। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যের জন্য অনেক বিকল্প থাকার পরও ঝুঁকি রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো কেনিয়াসহ কিছু আফ্রিকার দেশ খুব বেশি ধার নিয়েছে। জাম্বিয়া, ঘানা ও ইথিওপিয়া খেলাপি হয়ে গেছে এবং আইএমএফ অনুমান করেছে যে, ২৫টি আফ্রিকান দেশ ঋণ সংকটের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।’

অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের গবেষণা সংস্থা চ্যাথাম হাউজের আফ্রিকা বিভাগের প্রধান অ্যালেক্স ভাইনস বলেন, ‘আফ্রিকার দেশগুলো এখন জাতীয় স্বার্থকে ‘ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত’ করার চেষ্টা করছে। চিদি ওডিনকালুর মতো উদ্বিগ্ন প্রকাশ করে তিনি জানান, দেশগুলোর কাছে সবসময় সুবিধা নেয়ার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থাকে না।

একাধিক দেশকে বন্ধু হিসেবে নেয়ার কৌশল কাজ না করতে পারে বলেও জানান অ্যালেক্স ভাইনস। যেমন চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জাপানসহ বেশ কয়েকটি প্রতিযোগী দেশকে ঘাঁটি করার জন্য লোহিত সাগরের উপকূলরেখা ভাড়া দিয়েছে জিবুতি।

অন্যদিকে ব্রিকসের অন্যতম দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করছে। দেশটি পশ্চিমা শক্তি থেকে বিনিয়োগ টানার চেষ্টা করলেও রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে নৌ-মহড়ায় অংশ নিয়েছে।

তবে আফ্রিকা নিয়ে বাইরের দেশগুলোর অত্যধিক আগ্রহ সবসময় ভালো কিছু নাও হতে পারে বলে মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক কেন ওপালোর। যেমন সুদানের যুদ্ধে উপসাগরীয় রাষ্ট্র মিসর, ইউএই ও ইথিওপিয়ার মতো বিভিন্ন শক্তি জড়িত। সুদানের যুদ্ধ লিবিয়ার মতো সংঘাতে উপনীত হতে পারে, যা অনেক বিদেশী শক্তি জড়িত থাকার কারণে জটিল হয়ে ওঠেছে।

এখনো আফ্রিকাকে ইউরোপে অস্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ ও অভিবাসনের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে দেখা হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের জনসংখ্যা ২৫০ কোটিতে পৌঁছাতে পারে। এছাড়া আইএসআইএস ও আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট বিদ্রোহ এবং রাজনৈতিক বিদ্রোহকে সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব ঘটনার জাল পশ্চিমা বিশ্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। অ্যালেক্স ভাইনস জানান, আফ্রিকার অনেক দেশ বর্তমানে এসব ঘটনার ভেতর থেকে মধ্যম পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। তবে সে পথ অনেক কঠিন এবং সেখানে কিছু ভুল হিসাবও রয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *