মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ বৈচিত্র্যকরণ নীতিতে লাভবান হচ্ছে সিঙ্গাপুর
মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিনিয়োগ বৈচিত্র্যকরণ নীতি গ্রহণ করেছে। সে ধারায় বিশ্বব্যাপী নানা খাতে অর্থায়ন করছে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। এর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে এশিয়ার দেশগুলোয়, যার সুফল পাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র সিঙ্গাপুর। খবর দ্য স্ট্রেইটস টাইমস।
বেশ কয়েক বছর ধরেই উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। তাদের জ্বালানি তেলবহির্ভূত বিনিয়োগ দেশে-বিদেশে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। আবাসন, প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পর্যটন, বিদ্যুচ্চালিত যান (ইভি), শিক্ষা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করে ফল পেয়েছে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশ। এসব বিনিয়োগ প্রবাহের একটি বড় অংশ এসেছে এশিয়ার দেশগুলোয়।
২০২০-২৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীরা এশিয়া অঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের প্রাইভেট ক্যাপিটাল চুক্তি করেছে, যা ২০১৬-১৯ সাল নাগাদ বিনিয়োগকৃত ১ হাজার ২৯০ কোটি ডলার থেকে কয়েক গুণ বেশি। এসব চুক্তিতে ব্যাংকবহির্ভূত অন্য ঋণদাতা চ্যানেলে অর্থায়ন করা হয়েছে, যার একটি হলো বিনিয়োগ তহবিল।
বিনিয়োগবিষয়ক সংস্থা গ্লোবাল প্রাইভেট ক্যাপিটাল অ্যাসোসিয়েশনের (জিপিসিএ) গবেষণা বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেফ শ্লাপিনস্কি জানান, এশিয়ার বাজারে মধ্যপ্রাচ্যের করা ৪৩টি চুক্তির মধ্যে ৭ শতাংশ পেয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি। এর আর্থিক পরিমাণ ১ হাজার ২০৯ কোটি ডলার।
তবে ২০২০-২৩ সালে এশিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের চুক্তির ২০ শতাংশ দখল করে এ খাতে নেতৃত্ব দেয় ভারত। তাদের চুক্তি সংখ্যা ৬৮, পরিমাণ ১ হাজার ১৫০ কোটি ডলার।
বিনিয়োগে মধ্যপ্রাচ্যের আগ্রহ প্রসঙ্গে জেফ শ্লাপিনস্কি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের নির্ভরতা থেকে সরে আসতে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ কর্মসূচিই এশিয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীদের প্ররোচিত করেছে।’
বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে সিঙ্গাপুরের আলাদা একটি মর্যাদা রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দপ্তরের জন্য নগররাষ্ট্র বরাবরই আকর্ষণীয়। জেফ শ্লাপিনস্কি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারী গোষ্ঠী এশিয়ার বাজারগুলো ধরতে সিঙ্গাপুরে দপ্তর স্থাপন করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এশিয়া অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন অনেকগুলো প্রযুক্তি স্টার্টআপের কেন্দ্র এখন সিঙ্গাপুর। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ডিজিটাল অবকাঠামো প্লাটফর্মগুলো সিঙ্গাপুর থেকে বৃহত্তর অঞ্চলে পরিষেবা দিয়ে থাকে।’
সিঙ্গাপুর থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ৪৫ হাজার কোটি ডলারের কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি (কিউআইএ)। কোম্পানিটি ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরে নিজেদের অফিস চালু করে। সভরেন ওয়েলথ ফান্ড ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, কিউআইএ এখন বিশ্বের ১০ নম্বর বৃহত্তম সম্পদ তহবিল।
এছাড়া গালফ ক্যাপিটাল ও টিভিএম ক্যাপিটাল হেলথকেয়ারের মতো বিনিয়োগ তহবিলও সিঙ্গাপুরে দপ্তর স্থাপন করেছে। তাদের লক্ষ্য এশিয়া অঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়ানো ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক পোর্টফোলিও কোম্পানিগুলোর সম্প্রসারণে সহায়তা করা।
জিপিসিএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন ও ভারতে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেল ও গ্যাসের রফতানি বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে এশিয়া ও বাকি বিশ্বের এ অঞ্চলের সঙ্গে মোট বাণিজ্যের দুই-তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে।
জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্য চুক্তিগুলো জ্বালানি তেল থেকে উপসাগরীয় অর্থনীতির বৈচিত্র্যকরণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জোরদার করতে অগ্রসর হচ্ছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে বিনিয়োগকারী ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম গোল্ডেন গেট ভেঞ্চার্সের অংশীদার মাইকেল লিন্টস বলেন, ‘অঞ্চলটিতে এখন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা আজ থেকে সাত-আট বছর আগেও ছিল না। সৌদি আরব ও কাতার সম্ভাব্য সম্প্রসারণ বাজার হিসেবে সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া উভয়ের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হচ্ছে।’
গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে ২০২৩ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে সিঙ্গাপুর। যেখানে খাদ্যনিরাপত্তা, ডিজিটাল অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও জ্বালানির মতো বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, স্টোরেজ সলিউশন ও দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়।
একই বছর কাতারের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে সিঙ্গাপুর। চুক্তির আওতায় খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানি সম্পর্ক, উদ্ভাবন, পাবলিক সেক্টর ট্রেইনিং ও সাইবার সিকিউরিটির মতো বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে।