আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম আরো কমেছে
সয়াবিন তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে আরো কমেছে। বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত মাসিক প্রতিবেদনের (পিংক শিট) মার্চ সংস্করণের তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে পণ্যটির গড় মূল্য কমে প্রতি টন ৯১২ ডলারে নেমেছে, যা তিন বছরের সর্বনিম্নে। জানুয়ারিতে এর মূল্য ছিল ৯৭১ ডলার। যদিও বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে সেভাবে প্রভাব পড়েনি।
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কভিডকালে বাড়তে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ সংকট দেখা দিলে ২০২২ সালে তা সর্বোচ্চে ওঠে। তবে গত বছরের শুরুতেই ভোজ্যতেলটির দাম কমতে শুরু করে।
দেশে সাধারণত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন ও ব্যবসায়ীরা মিলে দেশে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে। পরে তা কার্যকরের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সর্বশেষ গত মাসে লিটারে ১০ টাকা কমিয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৩ ও খোলা তেল ১৪৯ এবং পাঁচ লিটারের বোতলজাতের মূল্য ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। নতুন নির্ধারিত এ দর ১ মার্চ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তেল বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই।
ভোজ্যতেলের বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে দাম সমন্বয়ের বিষয়ে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘দেশের সাধারণ ব্যবসায়ীরা বিশ্ববাজার কিংবা সরকার নির্ধারিত দামের ওপর নির্ভরশীল নন। মিল মালিক বা পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো যে দামে পণ্য বিক্রি করে সেটিই মেনে চলতে হয়। এখানে সাধারণ ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কমাতে বা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। তাছাড়া বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমে এলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়া সময়সাপেক্ষ বিষয়। তাও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা ট্যারিফ কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।’ আসন্ন রমজানে মিলগুলো থেকে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশীয় বাজারের দাম সমন্বয় হলে ভোজ্যতেলের বাজার কয়েক বছর আগের মতোই স্থিতিশীলতায় ফিরবে বলে মনে করছেন এ ব্যবসায়ী নেতা।
পিংক শিটের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল ১ হাজার ৩৮৫ ডলার। পরের বছর তা বেড়ে হয় ১ হাজার ৬৬৭ ডলার। তবে গত বছর গড় মূল্য ১ হাজার ১১৯ ডলারে নেমে আসে। বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তা ১ হাজার ১০৫ ডলারে লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে গত নভেম্বরে দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ১১৮ ডলার। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬২ ডলারে। এরপর জানুয়ারিতে তা আরো কমে হয় ৯৭১ ডলার। অর্থাৎ ২০২২-এর তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমে প্রায় ৪৫ শতাংশ।
এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার ঘোষণা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখী দাম ও আমদানি শুল্ক কমলেও দেশে সে হারে কমেনি সয়াবিন তেলের দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম অনেক বেড়েছে। সে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও তার সুফল দেশের মানুষ পাচ্ছে না। আবার মাত্র ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমানোর কারণে লিটারে ৭-৮ টাকা আমদানি খরচ কমবে।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মাওলা বলেন, ‘ডলারের দাম আগে কত ছিল, এখন কত সেটা বিবেচনার বিষয়। এখন অনানুষ্ঠানিক দর ১২২-১২৫ টাকায় চলে যায়। তবে আমরা আমদানি করি না। বিতরণও করি না। ভোজ্যতেলের দাম আমদানিকারক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেয়। সে অনুযায়ী তাদের থেকে আমরা কিনে নিই। মূলত তিন স্তর বিবেচনায় দাম নির্ধারণ করা হয় বলে জানি। মজুদ কত আছে, কী পরিমাণ তেল পাইপলাইনে আছে আবার কী পরিমাণ তেল বাজারে আছে তার বিবেচনায় দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। আগের তেল না থাকলে আরো কমানো সম্ভব ছিল।’
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে ২০২০ সালের মে মাসে দেশের বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৩৫-১৪০ টাকা। এর পরের বছর একই মাসে ছিল ১৩৫-১৪৫ টাকা। তবে ২০২২ সালের শুরুতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০-১৬০ টাকায়। আর ২০২৩ সালের শুরুতে এ দর ছিল ১৮৭-১৯০ টাকা।
সার্বিক বিষয়ে কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে রাতারাতি দেশের বাজারে বাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কমলে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নানা অজুহাতে আর দাম কমানো হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এত কমেছে, কিন্তু দেশের বাজারে কত কমেছে? সরকার নির্ধারণ করে দিলেও তা ব্যবসায়ীদের দেয়া দামই ঘোষণা করা হয়। দিন শেষে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নেয়া হয় না।’