নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে অর্থনীতি গতিশীল রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ

স্টাফ রিপোর্টার

আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘একপাক্ষিক’ দাবি করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, একপাক্ষিক নির্বাচন দেশকে সংকটে ফেলবে। তারা মনে করেন, এ নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা পাবে না। এর ফলে বাংলাদেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও বাধার মুখে পড়তে হতে পারে। বিশেষত, তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা এলে তা এ শিল্পে কর্মরত লাখ লাখ নারী ও সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাবে ফেলবে।

রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বুধবার (২০ ডিসেম্বর) এক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। ‘ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ: নির্বাচন, অর্থনীতি ও বহিঃসম্পর্ক’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। এতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

তারা বলেন, একতরফা নির্বাচন দেশের উন্নয়ন অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে আরও শীতল করে তুলবে। তাই গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন উপহার দিতে সব বড় দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এমন একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের কাছ আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বৈধতা থাকুক বা না থাকুক, আমরা একটি একপাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। এখানে সরকার দল কে হবে ও বিরোধী দল কে হবে তা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে এবং তথাকথিত বিরোধী দল এরই মধ্যে আসন ভিক্ষার রাজনীতি শুরু করেছে। এবারের নির্বাচনে আসন ভিক্ষার রাজনীতি নিয়ে অনেকেই অবাক হলেও, বিগত দুটি নির্বাচনেও এমনই ছিল।

তিনি বলেন, দেশের তরুণ সমাজ টানা তিনটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমান অচলাবস্থা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। রাজনীতি কখনো শূন্য থাকে না, কেউ না কেউ সেখানে চলে আসে। আমার ভয় হচ্ছে, এই অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে সেই শূন্যস্থানে চরমপন্থিরা চলে আসতে পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, যা নিয়ে কেউ খুব একটা কথা বলে না। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল, যা অসাংবিধানিক। এই পদ্ধতিতে হাইকর্টের রায়কে সঠিকভাবে মানা হয়নি। এছাড়া জনগুরুত্বপূর্ণ আইন বা বিধান পরিবর্তনের আগে গণভোট করার অত্যাবশ্যকীয়তা রয়েছে সংবিধানে। এক্ষেত্রে সেটিও অনুসরণ করা হয়নি।

তিনি বলেন, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন, অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে প্রণীত নিয়মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন ও একচেটিয়া অংশগ্রহণের এই নির্বাচন দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা খুবই ‘উদ্বেগজনক’ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মিলছে না। আমি মনে করি, দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী দেখিয়ে কিছু লোক অবৈধভাবে অর্থ লোপাট করেছে এবং তাদের নিজেদের পকেট সমৃদ্ধ করেছে, কিন্তু দেশের সমৃদ্ধি ঘটেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সমস্যা হলো আমরা আমাদের সংকটগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাই, মানতে চাই না। বহুদিন থেকে আমরা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ছিলাম। অথচ আমরা সেটা অস্বীকার করে বলেছি যে, না আমরা ভালো আছি। অথচ এখন আমরা মহাসংকটের দাঁড়প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি।

তিনি বলেন, এদিকে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে জবাবদিহির প্রচণ্ড অভাব। অনেকেই গণতন্ত্র আর অর্থনীতিকে আলাদা করে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অথচ অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করা যাবে না। গণতন্ত্রের অনেক সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু সেখানে যদি অংশগ্রহণ না থাকে, জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকে, তাহলে সেটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। গণতন্ত্রহীন সমাজে জবাবদিহি থাকে না, আর তার সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতির বিষয়ে সরকারের তৈরি বা প্রকাশ করা ন্যারেটিভ বা বক্তব্য দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিলে না। জিডিপিকে যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া গণনা করা যায় না, তাই সেখানে বেশি সংখ্যা বসিয়ে দিয়ে দেশকে উন্নত হচ্ছে বলে দেখানো হচ্ছে। অথচ, যে অর্থগুলো গণনা করা যায়, যেমন বৈদেশিক অর্থের রিজার্ভ, তা তো আর বাড়িয়ে বলা যায় না। তাই সেটি কম না দেখিয়ে উপায় নেই।

তিনি বলেন, সরকার যে কোনোভাবে একটা ইলেকশন করে ফেললেও তা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য না হলে এর প্রভাব অর্থনীতির ওপর এসে পড়বে। ফলে নির্বাচন পরবর্তী দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ও গতিশীল রাখাই হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আসন্ন নির্বাচনকে সবার মত ‘নির্বাচন’ বলতে নিজের দ্বিধা থাকার কথা জানিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এটিকে বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা বলা যায়।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বৈধতার সংকট থাকলে সেই রাষ্ট্র সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। সাম্প্রতিক দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক বৈধতা রক্ষা করতে পারলেও, রাজনৈতিক বৈধতা রক্ষা করা যায়নি। দেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি সমর্থন পাওয়া একটি দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা মানে হচ্ছে, এতগুলো মানুষকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা, যা এ নির্বাচনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয় না। এছাড়া যে নির্বাচন নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবক্ষকদের সন্তুষ্ট করতে পারে না, তা নৈতিক সমর্থনও পায় না। ফলে, সাংবিধানিক বৈধতা রক্ষা হলেও রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা নিশ্চিত হচ্ছে না।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল।
সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হুসাইন (অব.), নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমান্ডার (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ও ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির। এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *