এক মাসে টোল আদায় সাড়ে ৪ কোটি, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ৭১ কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন হয় গত ২৮ অক্টোবর। পরদিন থেকে শুরু হয় যান চলাচল। ২৯ অক্টোবর থেকে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এ টানেল ব্যবহার করা যানবাহন থেকে টোল আদায় হয়েছে ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর এ সময়ে টানেল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে খরচ হয়েছে ৭১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। টানেলটির নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করেছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকার চীনা ঋণ ২ শতাংশ সুদসহ আগামী ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। টানেলের নির্মাণ ব্যয় তুলে আনাসহ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তুলে আনার একমাত্র মাধ্যম যানবাহন থেকে আদায় হওয়া টোল।

সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, ২৮ অক্টোবর টানেলটি উদ্বোধনের পর থেকে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা টোল আদায় হয়েছে। এ টাকার ওপর আবার ভ্যাট পরিশোধ করা হয়েছে ৫৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। ভ্যাট বাদ দিলে আদায় হওয়া টোলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।

এর বিপরীতে একই সময়ে টানেল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ হয়েছে ৭১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের আয় ও ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চালুর পর প্রথম এক মাসে টানেল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে লোকসান হয়েছে প্রায় ৬৭ কোটি টাকা।

টানেল থেকে টোল আদায়ের বিপরীতে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের মধ্যে প্রায় ৬৭ কোটি টাকার পার্থক্যের বিষয়ে কথা হয় সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা কাজ শুরুর সময় ঠিকাদারকে মোবিলাইজেশনের জন্য শুরুতে টাকা দিতে হয়েছে। এর বাইরে চারটি স্ক্যানার যন্ত্র কেনা হচ্ছে, যেগুলো যানবাহন স্ক্যানের কাজে ব্যবহার হবে। ঠিকাদারের মোবিলাইজেশনের টাকা ও স্ক্যানার কেনার ব্যয় রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয়ের খাতে রাখা হয়েছে। মূলত এ কারণেই খাতটিতে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হয়েছে এবং টানেলের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বড় পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় তুলনামূলক বেশি হয়। তবে যত দিন যাবে আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য ধীরে ধীরে কমে আসবে এবং একসময় লাভজনক অবস্থায় চলে যাবে।’

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেলের নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয় ২০১৩ সালে। এতে বলা হয়, নির্মাণের পর টানেলটিতে দুই ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ কাজের দরকার হবে। এর মধ্যে একটি হলো ‘ডেইলি মেইনটেন্যান্স’। টানেলের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ, কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে অক্সিজেন সরবরাহসহ বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজের পেছনে বছরে ১৮ লাখ ডলার (২০১২ সালের হিসাবে) খরচ হবে। এছাড়া প্রতি পাঁচ বছর পর একবার বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, যেটাকে বলা হয় ‘রেগুলার মেইনটেন্যান্স’। একবার রেগুলার মেইনটেন্যান্স করতে খরচ হবে ১৯ লাখ ডলার।

রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও কর্মীদের বেতন, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক পরিচালন কাজে বছরে ব্যয় হবে ১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এ পরিচালন ব্যয় প্রতি বছর ৮ শতাংশ হারে বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয় সমীক্ষা প্রতিবেদনে।

প্রসঙ্গত, টানেল থেকে টোল আদায়ের জন্য যানবাহনের ১২টি শ্রেণী ও টোল হার নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। মাইক্রোবাস পারাপারের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। ৩১ বা তার চেয়ে কম আসনের বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা। এর চেয়ে বেশি আসনের বাসের জন্য দিতে হবে ৪০০ টাকা। অন্যদিকে তিন এক্সেলের বাসের জন্য ৫০০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। পাঁচ টন পর্যন্ত ট্রাকের জন্য দিতে হবে ৪০০ টাকা। পাঁচ থেকে আট টন পর্যন্ত ট্রাকের জন্য ৫০০ টাকা, আট থেকে ১১ টন পর্যন্ত ট্রাকের জন্য ৬০০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে তিন এক্সেলের ট্রাক/ট্রেইলারের টোল ধরা হয়েছে ৮০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রাক/ট্রেইলারের জন্য টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার টাকা। চার এক্সেলের বেশি হলে এক্সেলপ্রতি আরো ২০০ টাকা টোল দিতে হবে।

প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে টানেলটি নির্মাণ করা হয়েছে। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। চার লেনবিশিষ্ট দুটি টিউবের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। মূল টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে একটি ৭২৭ মিটার ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *