বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সংকোচনের আশঙ্কা
মহামারী-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া গতি হারিয়েছে। একদিকে বৈশ্বিক সরকারি ঋণ রেকর্ড উচ্চতায় রয়েছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে বিভক্ত করে রেখেছে ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন। চাহিদা কমে যাওযায় শিল্পোৎপাদন খাতের দুর্বলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়ার ঝুঁকি তো রয়েছেই। ফলে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে সংকোচনের আশঙ্কা। এমনকি কিছু দেশে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই স্থবির হয়ে পড়তে পারে। সম্প্রতি এমন সতর্কতা জানানো হয়েছে কানসাস সিটি ফেডারেল রিজার্ভের চালানো গবেষণায়। খবর রয়টার্স।
গবেষণায় দেখা গেছে, কভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে সরকারি ঋণ বেড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও চীন-মার্কিন বাণিজ্যিক টানাপড়েনে সংকট ঘনীভূত হয়েছে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে-অলিভিয়ের গৌরিঞ্চাস বলেছেন, ‘দেশগুলো বর্তমানে ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। মহামারী মোকাবেলার কারণে তারা তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বড় একটা অংশই ব্যবহার করে ফেলেছে। এখন শুধু রয়েছে নীতিমালার মাধ্যমে বলপ্রয়োগ, ভূরাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, বাণিজ্যিক টানাপড়েন এবং চীন ও পশ্চিমা অর্থনীতির দ্বন্দ্ব।’
গৌরিঞ্চাস মনে করেন, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক ৩ শতাংশে ঠেকতে পারে। চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া যখন দ্রুত ছিল, তখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ থাকবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়। অবশ্য অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, তুলনামূলক কম উন্নত দেশগুলোয় প্রবৃদ্ধি বেশি রাখা সম্ভব। আইএমএফের সাবেক অর্থনৈতিক প্রধান মরিস অবস্টফেল্ড দাবি করেছেন, মহামারী-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি অনেকটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চীনের অর্থনীতি নানা প্রতিবন্ধকতায় খাবি খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের বাণিজ্য নীতি বৈশ্বিক উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনকে অনেকটাই বিঘ্নিত করছে। অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা মূল্যস্ফীতিকেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অর্থনীতিবিদ সেরকান আরসালানআল্প দাবি করেছেন, প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বৈশ্বিক সরকারি ঋণ ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মহামারী-পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি এমন অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে সরকারি ঋণ দ্রুত কমিয়ে আনা সহজ নয়। সরকারি ঋণের পরিণামও দেশভেদে ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোয় সরকারি ঋণের বিপরীতে উচ্চ আয় রয়েছে। ফলে তারা তুলনামূলকভাবে দ্রুত বের হতে পারবে। কিন্তু ছোট অর্থনীতির দেশগুলো ভবিষ্যতে ঋণ সংকটে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে। ইউরোপীয় দেশ, জাপান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে প্রবীণ বাড়ছে। নাইজেরিয়ার মতো আফ্রিকার দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা। এর প্রভাব বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হিস্যায় দেশগুলোর অংশগ্রহণকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করবে।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধ মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। একইভাবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা তাদের মিত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার প্রধান এনগোজি ওকনজো ইউয়েলা দাবি করেছেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ঝুঁকি খুঁজে পাওয়া মোটেই সুখকর কিছু নয়। তবে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের জন্য কেবল নিকটসীমার বাইরেও ছড়িয়ে দিতে হবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক।
উৎপাদন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার একটা রাস্তা হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফল ব্যবহার। তবে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে, প্রযুক্তি কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আবিষ্কারের গতিও এখন কমে আসছে। প্রযুক্তিগত সংযোজন ধীর হবেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মার্কিন সফটওয়্যার কোম্পানি এডিপির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নিলা রিচার্ডসন বলেন, ‘চ্যাটজিপিটিকে আমি পেলোটনের মতোই মনে করি। আপনি চাইলে একে রেখে দিতে পারেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সবাই এগুলো ব্যবহার করবে।’