খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করেছে ৩৩ ব্যাংক
২০১৬ সালে ফজলে কবির বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংক পরিদর্শন ঝিমিয়ে পরে। ফলে অনেক ব্যাংক তথ্য গোপন করে। সম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নড়েচড়ে বসলেই বিষয়টি নজরে আসে। ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো খেলাপির হিসাবে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা কম দেখিয়েছে ৩৩ ব্যাংক। তবে ৯ ব্যাংক সঠিক হিসাব পাঠিয়েছে বলে পরিদর্শনে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দেখানো হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। হার ছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ফলে শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমে ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের যে তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছে পরিদর্শনের পর তা বেড়ে যায়। ৪২ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাত্র ৯ ব্যাংক খেলাপির সঠিক তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছে। সঠিক তথ্য পাঠানো ব্যাংকগুলো হচ্ছে- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, আল আরাফাহ ইসলামী, প্রাইম, সিটি, ব্র্যাক, মধুমতি, মিডল্যান্ড, কমিউনিটি ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
গরমিল পাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ৪ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। বেসরকারি ২৮ ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ফলে মোট ৩৩ ব্যাংক খেলাপি গোপন করেছে ১৮ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আবদুর রউফ তালুকদার ব্যাংকগুলোতে পুনরায় পরিদর্শনের নির্দেশ দেন। এতে ব্যাংকগুলোর নানা অনিয়ম বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে। এ অবস্থায় ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে কঠোর অবস্থানে যান এই গভর্নর। বিশেষ করে ঋণ অনিয়মে এমডিদের ওপর মালিক পক্ষ চাপ প্রয়োগ করলে তা গভর্নরকে অবহিত করা, কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, অনিয়মের মাধ্যমে অনুমোদিত ঋণ বিতরণ বন্ধ করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি।
রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক খেলাপির হিসাব কম দেখিয়েছে ২ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো তথ্যে খেলাপি ছিল ৬ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। কিন্তু পরিদর্শনের পর উল্লেখ করেছে ৯ হাজার ২২৫ কোটি টাকা।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) খেলাপি কম দেখায় ৯৭৯ কোটি টাকা। ওয়ান ব্যাংক কম দেখায় ৯০৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক কম দেখায় ৯০০ কোটে টাকা, জনতা ব্যাংক কম দেখায় ৮১১ কোটি টাকা। শীর্ষ দশে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৭১৫ কোটি টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক ৫৯৮ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৫৭৭ কোটি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক খেলাপির হিসাবে কম দেখায় ৫৪৮ কোটি টাকা।
এছাড়া খেলাপি ঋণ কম দেখানোর তালিকায় যমুনা, এনসিসি, ব্যাংক এশিয়া, ডাচ্-বাংলা, শাহজালাল ইসলামী, ট্রাস্ট, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, আইএফআইসি, প্রিমিয়ার, এবি, স্ট্যান্ডার্ড, গ্লোবাল ইসলামী, এক্সিম, মেঘনা, এনআরবি, উত্তরা, পূবালী, ইস্টার্ন ও সাউথবাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা তৈরি করতে ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখায়। এজন্য বিভিন্ন সুবিধা বা কৌশল গ্রহণ করে। এতে সঞ্চিতি কম রাখতে হয়। আবার ওই ঋণের বিপরীতে আদায় দেখানো যায়। এতে প্রকৃত তথ্য আড়ালে চলে যায় এবং মালিক পক্ষ লভ্যাংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। আবার কোনো কোনো সময় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের পারফরম্যান্স ভালো দেখাতেও তথ্য গোপন করে থাকে। এসব ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনের পর বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হয়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময় খেলাপির তথ্য উদঘাটন করার পর প্রভাব খাটিয়ে ওই তথ্য গোপন করা হয় বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপির তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গোপন করা একটি বড় অপরাধ। বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার ব্যাংকগুলোকে সুবিধা ও ছাড় দেওয়ার কারণে এ ধরনের সাহস তৈরি হচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরের ভালোর জন্য এখনই বাংলাদেশ ব্যাংককের শক্ত অবস্থানে যাওয়া উচিত।