জানুয়ারি-মার্চে কারখানা বন্ধ হয়েছে ৯৭টি

স্টাফ রিপোর্টার

আর্থিক সংকটে ক্রেতা দেশগুলোয় সংকুচিত হয়েছে চাহিদা। মিলছে না ক্রয়াদেশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে কারখানা চালু রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি শিল্পোদ্যোক্তাদের। শিল্প খাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় গত তিন মাসে কারখানা চালুর চেয়ে বন্ধ হয়েছে বেশি। চলতি পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কারখানা বন্ধ হয়েছে ৯৭টি। একই সময়ে বন্ধ থেকে নতুন করে চালু হয়েছে ৮৭টি কারখানা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ভাষ্যমতে, কভিডকালীন দুর্বিপাকেও অনেকেই এমন ক্রয়াদেশ সংকটে ভুগেছে। কিন্তু সে ভোগান্তি খুব বেশিদিনের ছিল না। এক পর্যায়ে ক্রয়াদেশে বড় উল্লম্ফনও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শিল্প খাতে এখন কভিডের চেয়েও বড় আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। ক্রেতা দেশগুলোর অর্থনীতিতে এরই মধ্যে জেঁকে বসেছে মন্দার আশঙ্কা। ক্রয়াদেশ নেই রফতানিমুখী কারখানাগুলোয়। বিশেষ করে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করা ছোট কারখানাগুলো এ মুহূর্তে বিপদে আছে সবচেয়ে বেশি।

গত দুই মাসে বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর একটি বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্য এমওএফ ফ্যাশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, কাজ না থাকায় বন্ধ হয়েছে কারখানাটি। একই কারণে বন্ধ হওয়া আরেকটি কারখানা রিম নিটিং লিমিটেড। গত তিন মাসে এমন ৯৭টি কারখানা বন্ধ হয়েছে।

কাজের অভাবের পাশাপাশি অর্থায়নে সংকটও কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তাদের বক্তব্য হলো ব্যাংকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পেয়ে কোনো কোনো উদ্যোক্তা তাদের কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার যেসব কারখানা বন্ধ থেকে চালু হয়েছে, সেগুলো কতদিন চালু থাকবে, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে সব কারখানাকেই কম বেশি ভুগতে হচ্ছে। ছোটখাটো কারখানা, সাব-কন্ট্রাক্ট বা ঠিকা পদ্ধতির কারখানাগুলোকে বেশি ভুগতে হচ্ছে। বড় বাজারভিত্তিক দেশগুলোয় বিক্রি স্বাভাবিক অবস্থায় না এলে কারখানা পর্যায়ক্রমে আরো কমবে। যেগুলো চালু হচ্ছে সেগুলোও দেখা যাবে বড় কারখানাগুলোর থেকে কাজের প্রতিশ্রুতি পেয়েই চালু হচ্ছে। আবার কাজের অভাবে বিক্রি হয়ে যাওয়া বন্ধ কারখানা নতুন উদ্যোক্তার হাতে চালুর ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু তারাও বিপদে আছে। তাদের টিকে থাকা নির্ভর করছে ক্রেতা দেশগুলো থেকে ক্রয়াদেশ পাওয়ার ওপর।’

দেশের শিল্প অধ্যুষিত ছয় এলাকা হলো আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনা। এসব এলাকায় মোট কারখানা আছে ৯ হাজার ৫৪৪টি। গত তিন মাসে কাজের অভাবে বন্ধ হওয়া ৯৭টির মধ্যে পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য ১৭টি। এ খাতের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য কারখানা সাতটি। এ সময় সুতা ও কাপড় উৎপাদনকারী বস্ত্র শিল্প মালিক সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্য কারখানা বন্ধ হয়েছে তিনটি। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে দুটি বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) আওতাভুক্ত। সব মিলিয়ে সংগঠন ও কর্তৃপক্ষের আওতাধীন বন্ধ কারখানা ২৯টি। আওতাবহির্ভূত অন্যান্য বন্ধ কারখানা ৬৮টি।

গত তিন মাসে বন্ধ বা চালু হওয়া কারখানাগুলোর একটি অংশ মূলত ঠিকা (সাব-কন্ট্রাক্ট) পদ্ধতিতে কাজ করা প্রতিষ্ঠান। মূলত বড় কারখানাগুলোর কাজ বাড়লে বন্ধ থাকা কিছু কারখানা চালু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা। তারা জানান, কিছু কারখানা চালু হচ্ছে মালিকানা বদলের পর। আবার কেউ কেউ দীর্ঘ প্রস্তুতির পর পেছাতে না পেরে কারখানা চালুতে বাধ্য হয়েছেন, যাতে করে ব্যাংকের সহায়তা অব্যাহত রাখা যায়।

জানতে চাইলে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘যে কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে সেগুলোর বড় অংশ কাজের অভাবেই বন্ধ হয়েছে। তবে ব্যাংকের চরম অসহযোগিতার কারণেও অনেক কারখানা কাজ থাকলেও বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন মালিকরা। যেসব কারখানা চালু হয়েছে সেগুলো দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির পরই চালু হয়েছে। আবার চালু হওয়া কারখানার মধ্যে ঠিকা পদ্ধতিতে কাজ করা কারখানাও আছে। যেসব কারখানা থেকে তারা ঠিকা নিত, সেসব কারখানায় কাজ আসায় এসব ঠিকা কারখানাগুলো চালু হয়েছে। তবে চালু হওয়া মানেই সংকট কেটে গেছে, এমনটা নয়। ২০২৩ সালজুড়ে এ সংকট অব্যাহত থাকবে। তবে আশা করছি ২০২৪ সালে সংকট কাটিয়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। ওই পর্যন্ত কারখানাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে অব্যাহত ব্যাংকিং সহায়তা প্রয়োজন।’

বিজিএমইএ সদস্য কারখানা গ্লোবাল মার্চেন্ট লিমিটেড বন্ধ ছিল গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কারখানাটি চালু হয়েছে গত মাসেই। একই সংগঠনের চালু হওয়া আরেকটি কারখানা এএম ফ্যাশন। এ দুটিসহ গত তিন মাসে নতুনভাবে চালু হওয়া মোট কারখানা ৮৭টি।

শিল্পসংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে নতুনভাবে চালু কারখানার মধ্যে বিজিএমইএ সদস্য কারখানা নয়টি। বিকেএমইএ সদস্য কারখানা পাঁচটি। বিটিএমএর সদস্য একটি। এ সময় বেপজার আওতাধীন ১৭টি কারখানা চালু হয়েছে। সব মিলিয়ে গত তিন মাসে সংগঠন ও কর্তৃপক্ষের আওতাধীন কারখানা চালু হয়েছে ১৭টি। আর সংগঠন ও কর্তৃপক্ষের আওতাবহির্ভূত চালু হওয়া কারখানার সংখ্যা ৭০।

পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভাষ্যমতেও উঠে এসেছে, ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার কারণেই একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়েছে। নতুন করে চালু কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে সতর্কভাবে কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সহনশীল হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন সংগঠনের সদস্য উদ্যোক্তারা।

বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে, সেগুলো মূলত কাজের অভাবেই বন্ধ হয়েছে। বর্তমানে কাজের সংকটের বিষয়টি কারো অজানা নয়। পোশাক শিল্পের অনেকেই এখন দাঁত কামড়ে শিল্প টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেলে বাধ্য হয়ে বন্ধের নোটিস দিচ্ছেন। যারা নতুন করে কারখানা চালু করছেন, তাদের সতর্ক হতে হবে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞ কারখানাগুলো যেখানে বন্ধ হচ্ছে, সেখানে নতুন করে কারখানা চালু করে টিকে থাকার বিষয়টি অনেক কঠিন হবে বলেই মনে করছি।’

শিল্প মালিকরা বলছেন, বড় বাজারভিত্তিক দেশগুলোর বর্তমান অগ্রাধিকারের বিষয় খাদ্য, জ্বালানি ও আবাসন বাবদ ব্যয়। দেশগুলোর চাকরির বাজারও ভঙ্গুর। ফলে একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বড় বাজারগুলোয় বিক্রি কমে যাওয়ার প্রভাব এসে পড়েছে বাংলাদেশে। আগে যে কারখানা তিন লাখ পিস ক্রয়াদেশ পেত, সেটি এখন পাচ্ছে এক লাখ পিস। এ পরিস্থিতিতে বড় কারখানাগুলো ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের বাজার ধরে টিকে থাকতে পারলেও তুলনামূলক ছোটগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা। আবার নতুন করে চালু কারখানাগুলোর মধ্যে একাংশ আগে বন্ধ হয়েছিল কাজের অভাবেই। নতুন উদ্যোক্তার হাতে হস্তান্তর হওয়ার পর সেগুলো চালু হচ্ছে। তবে বিদ্যমান ক্রয়াদেশ পরিস্থিতিতে তাদেরও টিকে থাকা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *