২৭ বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়েছে

জীবন ইসলাম
সরকারি-বেসরকারি ৭ ব্যাংক থেকে গত ২৭ বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার নামে আর ফেরৎ দেয়া হয়নি। গ্রাহকের কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে তা আদায় করাও সম্ভব হয়নি। এমনকি আইনের আশ্রয় নিয়েও ওই টাকা আদায় করা যায়নি; কারণ স্থগীতাদেশ দিয়ে টাকা আদায় বন্ধ করে রাখা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানায়।
সূত্র জানায়, সরকারি সোনালী ও জনতা ব্যাংক কোনো রকমে কমর সোজা করে দাঁড়াতে পারলেও সরকারি বেসিক ব্যাংক আজও সোচনীয় অবস্থায় পরে রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকে ঋণের আবেদন করলে যথাযথ জমানত প্রদান করতে হয়। ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাংকের আইন বিশেষজ্ঞ যাচাই-বাছাই করার পর ঋণ অনুমোদনের জন্য ব্যাংকের পর্ষদে পাঠানো হয়। পর্ষদ সকল কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ঋণ চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এসব নিয়ম কতটুকু মানা হয়; তা কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ব্যাংকের পর্ষদ বলতে পারবেন।
গ্রাহক নিয়ম না মেনে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছেন। পত্রিকায় রিপোর্ট হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শক কিংবা অবজারভার নিয়োগ দেয় ওই ব্যাংকে। ঋণের আদি অন্ত যাচাই-বাছাই করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এসব ঋণ গ্রহীতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংক বন্ধ হয়নি খোড়ায়ে খোড়ায়ে চলছে। সম্প্রতি এর সাথে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড যোগ হয়েছে। এছাড়াও সরকারি সোনালী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংক উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোকে জীবিত রেখেছেন, কিন্তু যে গতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিল, সেই গতি আর ফিরে পায়নি।
প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যাংক হচ্ছে- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লি. ব্যাংকের মোট মূলধন ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা ছিল। ঋণের নামে বেনামে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। ব্যাংকটি রক্ষা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ সরবরাহ করে টিকিয়ে রেখেছে; ব্যাংক বন্ধ হয়নি; তবে কমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না।
ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নাম পরিবর্তন করে হয়েছে- আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লি.। এ ব্যাংক থেকে নামে বেনামে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়। ব্যাংকটি বন্ধ হবার উপক্রম হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার উদ্যোগ নিয়ে ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রেখেছে। ব্যাংকটি বন্ধ হয়নি; খোড়ায়ে খোড়ায়ে চলছে।
ফার্মারস ব্যাংক নাম পরিবর্তন করে হয়েছে- পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড। এ ব্যাংক থেকেও নামে বেনামে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়; সরকারের নির্দেশে ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আইসিবি অর্থায়ন করে; ব্যাংকটি খোড়ায়ে খোড়ায়ে চলছে।
বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নামে বেনামে তুলে নেওয়া হয়। সরকার ব্যাংকটি স¦াভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা প্রদান করেছে। কিন্তু ব্যাংকটি স্বাভাবিক হতে পারেনি; খোড়ায়ে খোড়ায়ে চলছে।
সোনালী ব্যাংক থেকে দু’দফায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারি সর্ববৃহৎ এই ব্যাংকটির তেমন ক্ষতি হয়নি। কোনো রকমে কমর সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে।
জনতা ব্যাংক থেকে দু’দফায় ৫ হাজার কোটি টাকা নামে বেনামে তুলে নেয়া হয়েছে, সরকারি ব্যাংক হওয়ায় এ ব্যাংকটিও কোনো রকমে কমর সোজা করে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি সেরকারি সর্ববৃহৎ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার উপরে ঋণের নামে তুলে নেয়া হয়েছে। ব্যাংকটির আমানত দেড় লাখ কোটি টাকার উপরে হওয়ায় বড় ধরনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেয়েছে। তারপরও প্রায় পনের হাজার কোটি টাকা গ্রাহকরা এ ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে। এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংককে রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক মোটা অঙ্কের টাকা সরবরাহ করে কোনো রকমে চলার সুযোগ করে দিয়েছে।
সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর আবদুর রউফ তালুকদারকে প্রশ্ন করা হলে এর জবাব না দিয়ে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। এমনকি ঋণ গ্রহীতা কারো নাম বলতেও তিনি রাজি হননি।
সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যে টাকা ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বিভিন্ন সময় নেয়া হয়েছে। অথবা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের দিয়ে দিয়েছেন, ওই টাকা আদায় করার জন্য সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এরা যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে ওই টাকা আদায় করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *