দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা গ্যাস পায় না টেক্সটাইল শিল্প
দেশে চলমান গ্যাস সংকটের কারণে টেক্সটাইল শিল্প-কারখানাগুলো উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়েছে। এ শিল্পে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহের কথা থাকলেও কারখানাগুলো প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘণ্টা গ্যাস না থাকার কথা জানিয়েছে। যেটুকু সময় গ্যাস থাকে তাতে চাপজনিত সংকটে মিলগুলো উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে এ শিল্প বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মালিকরা।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায়। মূলত টেক্সটাইল খাতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিষয়ক সংকটগুলো তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, কভিড পরিস্থিতি মোকাবেলা করা গেলেও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের দেশের জ্বালানি খাতকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষ করে দেশে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দেয়ায় আমাদের টেক্সটাইল মিলগুলো দীর্ঘদিন ধরে কার্যত বন্ধ। ক্যাপটিভ পাওয়ার চালিয়ে আমরা যেসব শিল্প-কারখানা সচল রাখি, সেগুলোর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে তিনি সরকারকে তথা জ্বালানি বিভাগকে গ্যাস আমদানির আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে গ্যাস উৎপাদন স্থানীয় ও আমদানি মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৬৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। উচ্চমূল্যের কারণে পেট্রোবাংলা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রেখেছে। কিন্তু আমাদের মিলগুলোতে স্বাভাবিক হারে গ্যাস পেতে হলে দৈনিক সরবরাহ তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ দরকার। উচ্চমূল্যে গ্যাস আমদানির জন্য যদি সরকারকে বাড়তি কিছু অর্থও দিতে হয় সেটি দিতে শিল্পমালিকরা প্রস্তুত রয়েছেন।
বিটিএমএ সংবাদ সম্মেলনে দেশের গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে একটি ভিডিও প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করে। তাতে দেখা যায়, বর্তমানে পেট্রোবাংলা স্থানীয় গ্যাসফিল্ডগুলো থেকে দৈনিক ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ৩৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। এ সরবরাহ দিয়ে দেশের শিল্প খাত যেমন ভুগছে, তেমনি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে শুরু করে অন্যান্য খাতও গ্যাস সংকটে ভুগছে।
গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এবং শিল্প-কারখানা চালু রাখতে বিদ্যমান সরবরাহের পাশাপাশি বিটিএমএ আরো অন্তত ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানির আহ্বান জানায়। এর মধ্যে স্পট মার্কেট থেকে ২০০ এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর কথা জানায়।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, দেশের মোট চাহিদার ১৮ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করে টেক্সটাইল শিল্প। সরকার যদি আমাদের ২ লাখ ডলারের গ্যাস দেয় আমরা দেশে ৪৮ লাখ ডলারের রফতানি বাণিজ্য এনে দেব।
দেশে টেক্সটাইল শিল্পে অন্তত ১ হাজার ৭০০ কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ ঝুঁকিতে রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ অন্তত ১১টি শিল্প অঞ্চলে কারখানাগুলোয় গ্যাস সরবরাহ সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এসব এলাকার মিলগুলো উৎপাদন সক্ষমতার ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানিতে টেক্সটাইল খাতে মোট ২৯ বিলিয়ন ডলারের মূল্য সংযোজন হয়েছে। এর মধ্যে নিটওয়্যার খাতে মূল্য সংযোজনের হার ৬০ শতাংশ। দেশে গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প-কারখানাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজস্ব (ক্যাপটিভ) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। আর সেটি করতে না পারায় ডায়িংয়ের রঙ ও অন্যান্য রাসায়নিক কেমিক্যাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অব্যাহতভাবে চলতে থাকা এ লোকসান সামাল দিতে না পেরে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে চলে গিয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন বিটিএমএ সভাপতি।
গ্যাস সংকটের কারণে মিলগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় শিল্প মালিকরা অব্যাহতভাবে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানানো হয়। এতে শিল্প উদ্যোক্তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। দেশে প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতে বর্তমান বিনিয়োগের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগ। অব্যাহতভাবে মিলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ভিডিও প্রেজেন্টেশনে বিটিএমএ দেশের গ্যাস সরবরাহের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে। সেখানে গ্যাস আমদানিতে খরচ, আমদানি বাড়ালে বাড়তি খরচ এবং তার বিপরীতে রফতানি আয় কী দাঁড়াতে পারে সে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়।