এসএমই ব্যবসায় ট্রেড লাইসেন্স তৈরি-নবায়নে ব্যাপক দুর্নীতি

স্টাফ রিপোর্টার

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের নতুন লাইসেন্স সংগ্রহ ও নবায়নে অধিক ব্যাপক দুর্নীতি হয় বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। এছাড়া এসএমই ব্যবসা পরিচালনায় ৫২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানকেই ঘুস দিতে হয় বলে সিজিএস জানিয়েছে।

রোববার (১৬ অক্টোবর) এক জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিজিএস এ তথ্য জানায়।

সম্প্রতি সিজিএস এবং সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ (সিআইপিই) যৌথভাবে দেশের এসএমই খাতের সঙ্গে জড়িত ৮০০ জন জাতীয় প্রতিনিধি নিয়ে এসএমই সেক্টরের বর্তমান অবস্থার ওপর এই জরিপ করে। এদের মধ্যে ৪০০ জন উৎপাদন খাত এবং ৪০০ জন সেবাখাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জরিপটি ২০২১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিচালিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অর্ধেকের বেশি (৫২ দশমিক ০৬ শতাংশ) অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় পরিষেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ঘুস প্রদান করতে হয়। যেমন- নতুন লাইসেন্স তৈরি এবং নবায়ন, সরকারি সেবা ব্যবহার, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিন) সংগ্রহ, ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) সনদপত্র সংগ্রহ ইত্যাদি। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন মনে করেন, দুর্নীতি একটি সংক্রামক ব্যাধি। একটি বড় অংশ (৬২ দশমিক ৪ শতাংশ) বিশ্বাস করেন, প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেই দুর্নীতির শেকড় অন্তর্নিহিত।

৭১ দশমিক ৩ শতাংশ মনে করেন যে, দুর্নীতির অত্যধিক উপস্থিতি বাজারকে আরও অসম প্রতিযোগীতামূলক করে তোলে। অর্ধেকেরও বেশি উত্তরদাতা মনে করেন, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে কঠোর সরকারি নিয়মকানুন দুর্নীতি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই সমস্ত ধারণার কারণে জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ এসএমই উদ্যোক্তা (৬১ শতাংশ) অনৈতিক পথ বেছে নিয়েছেন।

নতুন লাইসেন্স তৈরি এবং নবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিশেষ উপস্থিতি যথাক্রমে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ৩১ দশমিক ৮ শতাংশ পরিলক্ষিত হয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ লোক যারা ঘুস প্রদান করেছেন তাদের মধ্যে ধারণা বিদ্যমান যে, সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘুস প্রদান করা প্রয়োজন এবং ঘুস প্রদান সময় বাঁচায়।

জরিপের তথ্যমতে, দুর্নীতির সব থেকে বড় জায়গাগুলো হচ্ছে- লাইসেন্স এবং রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত অফিসসমূহ ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ, ট্যাক্স অফিস ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, স্থানীয় সরকার/সিটি করপোরেশন/পৌরসভা ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ, ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ, পরিবেশ অধিদপ্তর ১২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। এসব তথ্য এটাই নির্দেশ করে, যেখান থেকে উদ্যোক্তাদের জনসেবা নেওয়ার কথা, সেখানেই তারা বেশি দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন।

বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীর মতে, অর্থ-সম্পদের প্রতি লোভ এবং সেই সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে স্বচ্ছতার অভাবই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করে। তবে এছাড়াও বেশকিছু কারণের কথা তারা উল্লেখ করেছেন।

এসএমই থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে সব থেকে বেশি যে ক্ষেত্র দুটির কথা উঠে এসেছে সেগুলো হচ্ছে- দুর্নীতিবিরোধী আইনের অনিয়মিত প্রয়োগ ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং দুর্নীতিবিরোধী আইনের একদমই প্রয়োগ না করা ৭৯ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাদারত্বের অভাব ৭৭ দশমিক ৪ শতাংশ, সেই সঙ্গে সেবাদানের ক্ষেত্রে ঘুসের জন্য অনুরোধ ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ সেবাগ্রহণকারীদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়, যেখানে সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের ক্ষেত্রে ঘুস গ্রহণ অথবা বিশেষ সুবিধা ভোগের প্রতি চাহিদা (৭৩ দশকি ৯ শতাংশ) দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করছে।

দুর্নীতির যে দুটি সর্বাধিক পরিচিত মাধ্যম জরিপে উঠে এসেছে সেগুলো হচ্ছে- উৎকোচ (৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ) এবং রাজনৈতিক প্রভাবের ব্যবহার (৬০ দশমিক ১ শতাংশ)। এছাড়াও এই তালিকায় রয়েছে চাঁদাবাজি (৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ), স্বজনপ্রীতি (৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ) এবং মাত্রাহীন পৃষ্ঠপোষকতা (৪৩ দশমিক ১ শতাংশ)। এ ধরনের দুর্নীতিই আমাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিবিম্বস্বরূপ, যেটা আমাদের অর্থনৈতিক খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জাতীয় সরকারের দুর্নীতির (২৭ দশমিক ৬ শতাংশ) চেয়ে স্থানীয় সরকারের দুর্নীতি মাধ্যমে এসএমই খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎকোচ, প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক (৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ) এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্কই হচ্ছে সহজে সেবাগ্রহণ এবং অবৈধভাবে টিকে থাকার তরিকা (৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ)।

জরিপের তথ্যমতে, ব্যাপকহারে বিস্তৃত দুর্নীতির তুলনায় অভিযোগ প্রদানের হার অত্যন্ত কম। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা কোনো না কোনো পর্যায়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন, যার মধ্যে ৭০ শতাংশ বলেছেন তারা অভিযোগ প্রদান করে নেতিবাচক ফলাফল পেয়েছেন।

যদিও সরকার বারবার বলছে, যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা ‘জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু অর্ধেকেরও কম (৪৬ দশমিক) অংশগ্রহণকারী মনে করেন, জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতিরোধে সত্যিই কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এদের আবার বেশিরভাগই মনে করেন না যে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

সরকারের দুর্নীতি প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর গবেষণায় দেখা যায়, এখানে অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগের পদ্ধতি। এখানে দুটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে-অভিযোগ ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং সহজে অভিযোগ করা যাচ্ছে কি না। দুটি ক্ষেত্রেই উত্তরদাতাদের সমানসংখ্যক ইতিবাচক ও নেতিবাচক উত্তর উঠে এসেছে। কাজেই আমরা বলতে পারি, অভিযোগব্যবস্থা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অনুকূলে না। হুইসেলব্লোয়ারদের অনিরাপত্তাও আরেকটি চিন্তার বিষয়, যেখানে অধিকাংশ উত্তরদাতা (৭২ দশমিক ৮ শতাংশ) তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

যেখানে অধিকাংশ উদ্যোক্তা (৫৫ দশমিক ১ শতাংশ) দুর্নীতি প্রতিরোধে তাদের ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সেখানে ৭৮ শতাংশের বেশি এসএমই উদ্যোক্তা স্বাধীনভাবে নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি প্ল্যাটফর্মে যোগ দিতে আগ্রহী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *