কম দামে চামড়া নিয়ে যাচ্ছে চীন

স্টাফ রিপোর্টার

বিশ্বের চামড়াজাত পণ্যের বড় বড় ব্র্যান্ড ইউরোপ-আমেরিকার। সেসব ব্র্যান্ডের ক্রেতারা চামড়া কেনার সময় এর মান, ট্যানারিগুলোর পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক রয়েছে কি না তা সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। থাকা লাগে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ। সেই পূর্ণাঙ্গ সনদ আছে দেশের একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের। যে কারণে চামড়ার মান ভালো হওয়ার পরও বিশ্ববাজারে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কম দামে চামড়া কিনে নিয়ে যাচ্ছে চীনের কোম্পানিগুলো। চীন এই সনদ এত গুরুত্ব দেয় না।

সুনির্দিষ্ট তথ্য না দিতে পারলেও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) বলছে, দেশ থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানির অর্ধেকই যাচ্ছে শুধু চীনে। বাকি ৩০ শতাংশ ব্যবহার হয় দেশের স্থানীয় শিল্পে।

বিটিএ’র তথ্য বলছে, রপ্তানিযোগ্য চামড়ার মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং ইউরোপের তিনটি দেশ ইংল্যান্ড, ইতালি ও পর্তুগালে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। এছাড়া আমেরিকার কিছু দেশে কিছু চামড়া যায়। এসব দেশ মিলে যে পরিমাণ চামড়া রপ্তানি হয়, তার সমপরিমাণ অথবা কিছুটা বেশি চামড়া রপ্তানি হয় শুধু চীনে। যেখানে চামড়ার দাম ওইসব দেশের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।

এ বিষয়ে বিটিএ’র সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, শুধু কমপ্লায়েন্স ইস্যু ঠিক না থাকার কারণে আমরা বাধ্য হয়ে চীনের সিন্ডিকেট মার্কেটে পড়ে থাকছি। বিশ্বব্যাপী অবারিত উৎস থাকার পরও সেটা কাজে লাগাতে পারছি না। চামড়া শিল্পের বৈশ্বিক মানসনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) থেকে সনদ পাচ্ছি না। ফলে বড় বাজার ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি। আবার স্থানীয় বাজারেও চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাধ্য হয়ে তাদের কম দামে চীনে চামড়া রপ্তানি করতে হয়। বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে করোনার প্রভাব কাটিয়ে চামড়াজাত পণ্যের বিক্রি বেড়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে দামও চড়া। সেখানে দেশ থেকে অর্ধেক চামড়া খুব কম দামে নিয়ে যাচ্ছে চীন।

তাজিন লেদার করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম বাড়ার সুবিধা অধিকাংশ রপ্তানিকারক নিতে পারে না। কারণ এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় সেখানে রপ্তানি হচ্ছে না। যারা আগে ওইসব দেশে রপ্তানি করতো, সেসব দেশের ব্র্যান্ডগুলো এখন এলডব্লিউজি সনদ বাধ্যতামূলক করেছে। ফলে অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

চীন ও ইউরোপের বাজারের তুলনা করে তিনি বলেন, যেখানে ইউরোপে প্রতি বর্গফুট চামড়া দুই ডলার ৮০ সেন্ট (১০০ সেন্ট এ ১ ডলার), সেটা চীনে ৯০ সেন্ট থেকে ১ ডলার ২০ সেন্টে বিক্রি করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা অর্ধেক চামড়া চীনে দিচ্ছি। তাহলে আমাদের লোকসান কী পরিমাণ হচ্ছে সেটা সহজে অনুমান করা যায়।

যদিও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার পরও শেষ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেশ বেড়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর (২০২১-২২) ১২৪ কোটি ৫২ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের থেকে রপ্তানিতে ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

তথ্য বলছে, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বেশ কয়েক বছর পর শত কোটির ঘরে পৌঁছেছে। পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর এ খাতের রপ্তানি কমতে থাকে। টানা দুই বছর রপ্তানি শত কোটি ডলারের নিচে থাকার পর বিদায়ী অর্থবছরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে খাতটি।

কাঁচা চামড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে চামড়ার তৈরি পাদুকা, বেল্ট, মানিব্যাগ, নানা ধরনের লেডিস ব্যাগ, বিভিন্ন ধরনের বাক্স, জ্যাকেট, হ্যান্ডগ্লাভস, গাড়িতে ব্যবহৃত জিনিসপত্র রপ্তানি হচ্ছে। সেগুলো প্রস্তুত হচ্ছে দেশের হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠানের ফিনিশড লেদারে (প্রক্রিয়াজাত)। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা ওয়েটব্লু চামড়া পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসছে ফিনিশড লেদার হিসেবে। দ্বিগুণ দামে কিনে সেগুলো দিয়ে পণ্য বানাচ্ছে দেশি কোম্পানিগুলো।

এ বিষয়ে বিটিএ’র সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকার বড় বড় ব্র্যান্ড চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য নিয়েছে। এরপর এলডব্লিউজির কারণে এসব ক্রেতা পণ্য নিচ্ছে না। তবে প্রতি বছর চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা ওয়েটব্লু চামড়া পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসছে ফিনিশড লেদার হিসেবে। দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে আমাদের। এটা হচ্ছে শুধু কমপ্লায়েন্সের অভাবে।

এ খাতের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডের কাছে চামড়া ও পণ্য রপ্তানি সম্ভব হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ খাত থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় সম্ভব। সেজন্য এ খাতের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ করতে হবে। পাশাপাশি কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও ঠিকঠাক প্রয়োজন। সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নীতিসহায়তা দিতে হবে। ট্যানারিগুলোর পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনার সমস্যা কেটে গেলে এ খাত চূড়ান্ত সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *