দুর্দশায় পড়ল যেভাবে শ্রীলঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটই শেষ পর্যন্ত প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেকে ক্ষমতাচ্যুত করে ছাড়ল। বুধবার দিনের আলো ফোটার আগেই রাজাপাকসে সামরিক বিমানে চড়ে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়ে যান।

এর আগে শনিবার বিক্ষোভকারীরা কলম্বোর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দখল নিলে এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দিলে পার্লামেন্টের স্পিকার প্রেসিডেন্ট গোটাবায় বুধবারই পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছিলেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যাপক ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতিতে ক্ষীপ্ত সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা অনেকদিন ধরেই গোটাবায়ার পদত্যাগ দাবি করে এলেও অবসরপ্রাপ্ত এ সামরিক কর্মকর্তা জরুরি অবস্থা জারিসহ নানান উপায়ে গদিচ্যুতি ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছেন।

শেষ পর্যন্ত সেসব চেষ্টা বিফলে গেল, শ্রীলঙ্কাকে ভয়াবহ সংকটের মুখে ফেলে দেশ ছেড়েই পালাতে হল রাজাপাকসে পরিবারের এ গুরুত্বপূর্ণ সেনানীকে।

সোয়া দুই কোটি জনসংখ্যার দ্বীপদেশটি অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে বেইলআউট নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে এবং সার্বভৌম ঋণ পুনর্বিন্যাস নিয়ে অন্যদের সঙ্গে যখন আলোচনা চালাচ্ছিল। তখন প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতা ও রাজনৈতিক নৈরাজ্য ওই উভয় আলোচনাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

যেভাবে এখানে এল শ্রীলঙ্কা

বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয়, রপ্তানিযোগ্য পণ্য ও সেবার উৎপাদন পর্যাপ্ত মাত্রায় উন্নীত না করাসহ টানা কয়েকটি সরকারের নানান অব্যবস্থাপনাই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে।

২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজাপাকসে সরকার ব্যাপক হারে কর কমালে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে চলে যায়। তার কয়েক মাস পরই আঘাত হানে কোভিড-১৯ মহামারী।

এসবের কারণে শ্রীলঙ্কার রাজস্ব আয়ের বেশিরভাগ উৎসই নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। লাভজনক পর্যটন শিল্পে ধস নামে, বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠানোও হ্রাস পায়। বৈদেশিক মুদ্রার জটিল বিনিময় পদ্ধতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

দেশটির সরকারের আয় কমে যাওয়া এবং বিদেশি ঋণের বড় বড় কিস্তি পরিশোধে সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থেকে রেটিং সংস্থাগুলো ২০২০ সাল থেকে শ্রীলঙ্কার ক্রেডিট রেটিং নামাতে থাকে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকারও কলম্বোর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

অর্থনীতিকে সচল রাখতে শ্রীলঙ্কার সরকারকে তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। যে কারণে মাত্র দুই বছরে তাদের রিজার্ভের ৭০ শতাংশের বেশি খরচও হয়ে যায়।

বিদেশি মুদ্রার এই সংকটই এক সময় উন্নয়নশীল অর্থনীতির মডেল হিসেবে পরিচিত দেশটির অর্থনীতি পঙ্গু করে দেয়। তীব্র জ্বালানী ঘাটতিতে ফিলিং স্টেশনগুলোতে গাড়ির লাইন দীর্ঘ হতে শুরু হয়। বিদ্যুৎ বিভ্রাট ক্রমাগত বাড়তে থাকে, হাসপাতালে ওষুধ ফুরিয়ে যায়।

মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে গত মাসে তা ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছায়, সামনে এটি ৭০ শতাংশ হয়ে যাবে বলেও আশঙ্কা দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

সরকার কী করেছে

অর্থনীতির দিন দিন খারাপ হতে থাকলেও শুরুর দিকে রাজাপাকসে সরকার আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় তেমন আগ্রহী ছিল না।

মাসের পর মাস ধরে বিরোধী দলের নেতা ও বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন; কিন্তু সরকার তাতে কান দেয়নি। তাদের আশা ছিল পর্যটন খাত শিগগিরই চাঙ্গা হয়ে যাবে, রেমিটেন্সের প্রবাহও বাড়বে।

সেটি না হয়ে সংকট যখন মারাত্মক আকার ধারণ করল, তখন রাজাপাকসে সরকারের টনক নড়ল। তারা ভারত ও চীনের মতো অনেক দেশের সাহায্য চাওয়া শুরু করল।

শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে দুই প্রভাবশালী দেশ ভারত ও চীন বেশ সক্রিয়। দুই দেশ দুইভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।

নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য পরিশোধে সহায়তায় শত শত কোটি ডলার ঋণ দিল নয়া দিল্লি, সব মিলিয়ে এ বছর এখন পর্যন্ত তারা কলম্বোকে সাড়ে তিনশ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে বলে ভাষ্য ভারতের।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে পালিয়ে গেলেন মালদ্বীপে

শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে রাজত্বের কলঙ্কময় ইতি; চীন প্রকাশ্যে কোনো সহযোগিতার ঘোষণা না দিলেও ঋণ পুনর্বিন্যাসে দ্বীপদেশটিকে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করে।

শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা আইএমএফের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করে।

এরপর কী

শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী তার দায়িত্ব নেবেন।

কিন্তু এখন যিনি প্রধানমন্ত্রী, সেই রনিল বিক্রমাসিংহেও এরই মধ্যে সর্বদলীয় সরকার গঠনের স্বার্থে পদ ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।

তেমনটা হলে স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনকেই পার্লামেন্টে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব চালিয়ে নিতে হবে। ন্য়িম অনুযায়ী, আইনপ্রণেতারা যে নতুন প্রেসিডেন্ট ঠিক করবেন, তিনিই ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত, গোটাবায়ার বাকি মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন, বলেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ জয়দেবা উয়ানগোদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *