দাম কমছে এলএনজির

স্টাফ রিপোর্টার

আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম কমছে দুই মাস ধরে। দুই মাসে স্পট মার্কেটে জ্বালানি পণ্যটির দাম কমেছে প্রতি এমএমবিটিইউতে প্রায় ১৩ ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের ধারাবাহিকতায় এলএনজি আমদানিতে ব্যয় কমছে পেট্রোবাংলার। বিষয়টি স্বস্তির জানিয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সংকটও কমে আসবে।

পেট্রোবাংলা-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত তিন মাসে এলএনজি আমদানিতে সংস্থাটির কার্গোপ্রতি ব্যয় ১০০-১৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত কমেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে পেট্রোবাংলাকে দেয়া সরকারি ভর্তুকির ওপরও চাপ কমে আসবে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, দেশের গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে স্পট থেকে এলএনজি ক্রয় অব্যাহত রেখেছি। আমরা সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে এলএনজি ক্রয় করছি। একই সঙ্গে স্পট মার্কেটে মূল্যহ্রাসের বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছি। এভাবে মূল্য কমতে থাকলে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্যটি কেনা গেলে আশা করছি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এলএনজির ঘাটতি থাকবে না।

মহামারীর অভিঘাতপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদার কারণে গত বছরের শেষার্ধে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বাড়তে থাকে। স্পট মার্কেট থেকে পণ্যটি আমদানিতে পেট্রোবাংলার ব্যয় হয় প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৫ ডলার ৮৯ সেন্ট করে। একপর্যায়ে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ৫৫ ডলারের ওপরে উঠে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা যায়। গ্যাসের দামও ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ৮০ ডলারের ওপরে উঠে যায়।

জ্বালানির বাজার পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পূর্বাভাস দিয়েছিল চলতি বছরে স্পট মার্কেটে এলএনজির মূল্য কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে রাশিয়ার জ্বালানি বিপণন কৌশলের কারণে বাজারে পূর্বাভাসটির প্রতিফলন দেখা যায়নি। রাশিয়ার পেমেন্ট কৌশলে আটকা পড়ে ইউরোপীয় দেশগুলো অন্য স্থান থেকে গ্যাস ক্রয়ের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। একই সঙ্গে ইউরোপে গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হওয়ায় এখন গ্যাসের চাহিদাও কমেছে। এর ধারাবাহিকতায় এশিয়ার এলএনজি বাজারে পণ্যটির দাম কমছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

জ্বালানি বাজার পর্যবেক্ষণকারী সংবাদমাধ্যম এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটসের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ার স্পট মার্কেটে গত ২২ মে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির গড় মূল্য ছিল ২২ ডলার ৪০ সেন্ট করে। গত সপ্তাহের তুলনায় প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজিতে ৯৫ সেন্ট কমেছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না হলে এলএনজির দাম আরো কমে যাবে।

এদিকে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম কমার সুবাদে গত কয়েক মাসে পণ্যটি কিনতে পেট্রোবাংলার খরচও কমেছে। গত তিন মাসে কার্গো আমদানিতে গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ খরচ কমেছে বলে সংস্থাটি সূত্রে জানা গেছে। পেট্রোবাংলা বলছে, স্পট থেকে এলএনজি কার্গো আমদানি করতে এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে ১০ শতাংশ খরচ কমেছে।

সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চলতি মাসে সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়ার কাছ থেকে এক কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দেয়। এ কার্গো আমদানিতে খরচ পড়ে প্রায় ৯০৯ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়েছে ২৬ দশমিক ৪০ ডলার। এর আগে গত এপ্রিলে স্পট মার্কেট থেকে এক কার্গো এলএনজি আমদানি করতে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজিতে ব্যয় হয় ২৯ দশমিক ২৫ ডলার। ওই কার্গো আমদানিতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৯৯১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

চলতি বছরের মার্চে পেট্রোবাংলা স্পট মার্কেট থেকে আরো এক কার্গো এলএনজি আমদানি করে। সে সময় প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানিতে সংস্থাটির ব্যয় হয় ৩৬ দশমিক ৭০ ডলার। অর্থাৎ গত দুই মাসের ব্যবধানে স্পট এলএনজি আমদানিতে এমএমবিটিইউপ্রতি খরচ কমেছে প্রায় ১১ ডলার।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, এলএনজির মূল্য এ সময়ে যে কমে যাবে, তার পূর্বাভাস আগেই ছিল। তার কারণ মূলত ইউরোপের শীত মৌসুমে এলএনজির চাহিদা কমে যাওয়া এবং এশিয়ার বৃহৎ জ্বালানি আমদানি দেশগুলোর আমদানি তত্পরতা। তবে এটি ১৫ ডলারের নিচে নামার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে যতটুকু কমছে বাংলাদেশের জন্য এখন স্পট এলএনজি আমদানির সুযোগ তৈরি হয়েছে। চাহিদার ভিত্তিতে স্পট থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াতে পারে সরকার। মূল্য কমায় এলএনজি আমদানিতে জ্বালানি বিভাগের ওপর আর্থিক চাপও কিছুটা কমবে।

বর্তমানে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে দৈনিক সাড়ে ৭০ কোটি ঘনফুটের মতো আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি আমদানি চুক্তি ও স্পট মার্কেট থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে এ গ্যাস সংগ্রহ করা হচ্ছে। জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া এলএনজির ৫০ কোটি ঘনফুট আসছে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমদানীকৃত গ্যাস থেকে। বাকিটা আসছে স্পট মার্কেট থেকে। বর্তমানে মূল্য আরো কমে যাওয়ায় পেট্রোবাংলার জন্য স্পট মার্কেট থেকে আরো বেশি গ্যাস ক্রয় সহজ হয়ে এসেছে। এতে দেশে বিদ্যমান গ্যাসের সংকট অনেকটাই প্রশমন করা যাবে বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা।

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় দুটি দেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে বাংলাদেশ। দেশ দুটি হলো কাতার ও ওমান। দুটি দেশ থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানি করতে ১০ ডলারের কিছু বেশি খরচ পড়ে। অন্যদিকে ২০২০ সালে স্পট মার্কেট থেকে প্রথম এলএনজি কার্গো আমদানি করে বাংলাদেশ। দাম কম থাকায় শুরুতে পণ্যটি কিনে লাভবানও হয়েছিল পেট্রোবাংলা। তবে এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কারণে স্পট মার্কেট থেকে কম মূল্যে পণ্যটি ক্রয় করতে পারেনি সংস্থাটি।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এলএনজি মূল্য কমার বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। মূল্য কমে গেলে বাড়তি কার্গো সরবরাহেরও পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। তবে এ মুহূর্তে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই করার পরিকল্পনা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *