খাতুনগঞ্জে কমেছে সয়াবিন তেলের দাম

স্টাফ রিপোর্টার

সারাদেশে ভোজ্যতেল নিয়ে থামছে না হাহাকার। রেকর্ড পরিমাণ আমদানি ও মিল থেকে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও কৃত্রিম মজুতের কারণে কাটছে না সংকট। অবৈধভাবে মজুতের দায়ে প্রতিদিন জরিমানা করছে ভোক্তা অধিকার। গত ৫ মে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ৩৮ টাকা, খোলা ৪০ টাকা ও পাম তেলে ৪২ টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবু দেশজুড়ে ভোজ্যতেলের সংকট। তবে উল্টো চিত্র দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের।

ঈদের আগে যে খোলা সয়াবিন তেল মণপ্রতি সাড়ে সাত হাজার টাকা ছিল, তা সোমবার (৯ মে) বিক্রি হয়েছে সাত হাজার দুইশ টাকায়। একইভাবে পাম তেল ছয় হাজার পাঁচশ টাকা বিক্রি করা হলেও সোমবার বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার দুইশ টাকায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর পর আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। যার প্রভাব খাতুনগঞ্জে পড়তে শুরু করেছে। যে কারণে খোলা তেলের দাম বাড়ানো হলেও খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে দাম কমেছে।

এদিকে, সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর হিসাবমতে, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সারাদেশে ভোজ্যতেলের সংকট দেখা দিলেও চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে চাহিদার এক তৃতীয়াংশ বেশি ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের গত ৮ মে পর্যন্ত (বছরের প্রথম ১০ মাস ৮ দিনে) ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৩৫৮ মেট্রিক টন তেল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে পাম তেল ১৯ লাখ ২ হাজার ৫১০ টন ও সয়াবিন তেল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৮৪৮ টন।

সবশেষ ১৫ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৫৪ দিনে আমদানি হয়েছে চার লাখ ৯১ হাজার ৩০৩ মেট্রিক টন তেল। এর মধ্যে পাম তেল তিন লাখ ১৬ হাজার ৬৪৩ মেট্রিক টন। সয়াবিন তেল এক লাখ ৭৪ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন। এখনো অর্ধেকের বেশি বন্ডেন্ড ট্যাংক থেকে খালাস নেননি মিলাররা।

ঈদের আগে-পরে ৮ দিনে (১ মে থেকে ৮ মে পর্যন্ত) ১৯ হাজার তিনশ টন পাম তেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে শুল্কায়ন পরবর্তীসময়ে মিলাররা খালাস নিয়েছেন সাত হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত পাম তেল। এই ৮ দিনের সয়াবিন তেল খালাস নেননি মিলাররা।

অন্যদিকে, ঈদের পর গত ৫ মে (বৃহস্পতিবার) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

নতুন দর অনুযায়ী, খোলা সয়াবিন তেল লিটার প্রতি ১৪০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটার প্রতি ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়েছে। ৫ লিটারের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৯৮৫ টাকা। তাছাড়া পরিশোধিত পাম সুপার তেল ১৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭২ টাকা করা হয়েছে।

এদিকে, খুচরা বাজারে দাম বাড়ানো হলেও পাইকারি বাজারে দাম ছিল নিম্নমুখী।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, বাজার সক্ষমতার অতিরিক্ত ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) বাজারে ছেড়ে টাকা তুলে নেওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট কমে যাওয়া ও ঈদের পর চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমছে। সামনে আরও কমতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডিও ব্যবসায়ী বলেন, দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপ খাতুনগঞ্জের বাজারে অগুণিত ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ছেড়েছে। যা বাজারের সক্ষমতার বেশি।

ডিও ব্যবসায়ী আবু তাহের বলেন, ‘বাজারে ঈদের আগে পাম তেল প্রতিমণ সাড়ে ছয় হাজার ছাড়িয়েছিল। কিন্তু গত সোমবার সেই পাম তেল ছয় হাজার দুইশ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। সোমবার বাজারে এস আলমের পাম তেল প্রতিমণ ছয় হাজার দুইশ টাকা হলেও ঢাকার সিটি গ্রুপের ডিও বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার চারশ টাকার বেশিতে।’

এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জের তেল চিনির বড় ব্যবসায়ী আরএম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ  বলেন, খুচরা বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু খাতুনগঞ্জে তেলের দাম উল্টো কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় গত কয়েকদিন ধরে বুকিং রেট কমছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে আরও কমবে। যে কারণে খাতুনগঞ্জের বাজারে প্রভাব পড়েছে।

তিনি বলেন, ‘এখন ইন্টারনেট প্রযুক্তির কল্যাণে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য জেনে যাচ্ছেন। এতে খাতুনগঞ্জের বাজারও প্রভাবিত হচ্ছে।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আমদানিকারক, সরকার সবার পক্ষে কথা বলার জন্য লোক আছে, মিডিয়া আছে। কিন্তু ভোক্তাদের পক্ষে কেউ নেই। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝে মধ্যে মনিটরিং করছে। প্রশাসনের আর কোনো সংস্থাকে মাঠে চোখে পড়ছে না।’

তিনি বলেন, ঈদের পর তড়িঘড়ি করে খোলা বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ এর আরও ১৫ দিন আগে থেকে মিলাররা বাজারে তেল সরবরাহ বন্ধ করে রাখে। তখন তাদের (মিলার) ধরার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যখন দাম বাড়ানো হচ্ছিল, তখন দেখা যাচ্ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম পড়তির দিকে। ঠিক সেই সময়ে আমাদের দেশে খোলা তেলের দাম বাড়িয়ে মিলারদের লাভবান করা হয়েছে। ভোক্তাদের প্রতারিত করা হয়েছে। দাম বাড়ানোর বিষয়টি সরকার চাইলে আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে পারতো। এখন ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোতে আনুষঙ্গিক অনেক জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই বেড়ে গেছে।’

তিনি বলেন, আমাদের দেশে একটি রেওয়াজ আছে, কোনো প্রকারে একবার পণ্যের দাম বাড়ানো গেলে পরে সেটা আর কমে না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *