কয়লার মূল্য ২০০ বছরে সর্বোচ্চ
আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছরের জুনেও কয়লার মূল্য ছিল টনপ্রতি ১০০ ডলারের নিচে। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে গতকাল তা দাঁড়িয়েছে টনপ্রতি রেকর্ড সর্বোচ্চ ৪৬২ ডলারে। আন্তর্জাতিক কয়লা বাণিজ্যের দুই শতকের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ। তবে পণ্যটির বাজারদরের ঊর্ধ্বমুখিতা এখানেই থামবে না বলে আশঙ্কা করছে অসলোভিত্তিক জ্বালানি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাইস্ট্যাড এনার্জি। সংস্থাটি মনে করছে, চলতি বছরেই কয়লার টনপ্রতি মূল্য ৫০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়লার আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার প্রথম লক্ষণ দেখা যায় গত জুনের পর। ওই সময় জ্বালানি পণ্যটির টনপ্রতি মূল্য ছিল ৯৭ ডলার। অক্টোবরে তা উঠে যায় ২৭৮ ডলারে। এরপর বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরলে চলতি বছরের শুরুতে তা আবার ১২০ ডলারে নেমে আসে। ইউক্রেন সংকটের আভাসে আবার দাম বাড়তে শুরু করে পণ্যটির। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালেও পণ্যটি বিক্রি হয়েছে প্রতি টন ১৮৬ ডলারে। আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার-বিষয়ক সংবাদমাধ্যম হেলেনিক শিপিং নিউজের তথ্য অনুযায়ী, ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও পণ্যটির বর্তমান মূল্যস্তর ওই সময়েও ছিল অনেকটাই ধারণাতীত। কিন্তু এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় পণ্যটির মূল্য রীতিমতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এ অস্থিরতা কতদিন বজায় থাকবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারছে না কেউই।
জ্বালানি পণ্যটির নজিরবিহীন এ ঊর্ধ্বগতি এখন দেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। দেশের বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন উৎপাদনে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। জ্বালানি পণ্যটির এ ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সময়মতো চালু করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে বর্তমানে ৭ হাজার ৯৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার সাতটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এর মধ্যে রামপালসহ তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতি বছরেই উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আগামী বছর উৎপাদনে আসবে দুটি। বাকিগুলোও ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রেই জ্বালানি হিসেবে আমদানীকৃত কয়লা ব্যবহার করার কথা রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লা আমদানির সম্ভাব্য উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা রয়েছে তিনটি দেশকে—ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। মূলত এ কয়টি দেশের কয়লাকেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে মানসম্মত হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া রাশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে উত্তোলিত কয়লাকে মানসম্মত বিবেচনা করা হলেও দেশটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পশ্চিমাদের আরোপিত একের পর এক বিধিনিষেধ সেখান থেকে জ্বালানি আমদানিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় দেশগুলো এখন ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়লা আমদানি বাড়াতে তত্পরতা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানিবিষয়ক সংবাদমাধ্যমগুলোর ধারণা, দেশ তিনটির অদূরভবিষ্যতে ইউরোপের বাজারে বৃহৎ সরবরাহকারীতে পরিণত হওয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে দেশ তিনটিকে সরবরাহের গতিমুখ এশিয়া থেকে ইউরোপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হতে পারে।
এ মুহূর্তে দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে দুটি। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলছে স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলিত কয়লা দিয়ে। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করতে হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে সামনের দিনগুলোয় এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন চালু রাখা নিয়েও বড় ধরনের সংশয় রয়েছে।
যদিও এ মুহূর্তে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তেমন একটা নেই বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মাওলা বলেন, বৈশ্বিকভাবে কয়লার বাজার অস্থির হলেও এ মুহূর্তে পায়রার ওপর এর কোনো প্রভাব নেই। আগামীতে পণ্যটি আমদানিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
মূলত সাশ্রয়ী জ্বালানি বিবেচনায়ই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সরকার। এক্ষেত্রে কয়লার মূল্যে টনপ্রতি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১২০ থেকে ১৫০ ডলার। যদিও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যটির মূল্য দাঁড়িয়েছে উল্লিখিত মার্জিনের চেয়ে তিন গুণেরও বেশিতে।
বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখাটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, শুধু এলএনজির বাজারদর বেড়ে যাওয়ায়ই দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত তীব্র সংকটে পড়ে গিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কয়লার মূল্য যেভাবে লাগামহীন হয়ে উঠছে, তাতে সামনের দিনগুলোয় এ সংকট আরো ভয়াবহ ও মারাত্মক আকার ধারণ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন হলো ইউরোপ মহাদেশে কয়লার সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। গত বছরও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় মোট ৩ কোটি ৬০ লাখ টন কয়লা সরবরাহ করেছিল রাশিয়া, যা দেশগুলোর মোট কয়লা আমদানির ৭০ শতাংশ। চলমান যুদ্ধ ও পশ্চিমা বিধিনিষেধের কারণে দেশগুলোয় কয়লা সরবরাহ এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। এ অবস্থায় জ্বালানির সংস্থান করতে গিয়ে রাশিয়ার বাইরে বৃহৎ কয়লা রফতানিকারক দেশগুলো থেকে পণ্যটির আমদানি বাড়াতে তত্পরতা শুরু করেছে ইউরোপীয় দেশগুলো। চাহিদা ও সরবরাহ কাঠামোর এ আকস্মিক পরিবর্তনই জ্বালানি পণ্যটির বাজারকে অস্বাভাবিক মাত্রায় অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বৈশ্বিকভাবে কয়লার মূল্যে যে পরিস্থিতি তাতে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলোর জ্বালানির জোগান নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কয়লা থেকে সাশ্রয়ী মূল্যের যে বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা ছিল সে সুযোগ এখন আর নেই। কারণ জ্বালানির যেকোনো একটি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলে পরবর্তী সময়ে বাকি পণ্যগুলোর দামও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
কয়লার বাজারদরের বর্তমান গতিপ্রকৃতিতে দেশে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যথাসময়ে চালু করা গেলেও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে বলে পিডিবির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ দাবি করছে, দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোয় চলমান বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের সরাসরি কোনো প্রভাব নেই। দেশের প্রকল্পগুলোয় কয়লা আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার সরবরাহকারী দেশগুলো থেকে। ফলে কয়লার মূল্যবৃদ্ধি পেলেও সরবরাহ সংকট হবে না।
বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি বিচার করলে আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোয় তেমন কোনো প্রভাব আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কারণ বৈশ্বিক জ্বালানি দরের ঊর্ধ্বমুখিতা মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এটি সাময়িক। এ সমস্যার সঙ্গে আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সরাসরি কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কয়লা উত্তোলন বাড়ানোরও এ মুহূর্তে কোনো পরিকল্পনা নেই সরকারের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, স্থানীয় কয়লা উত্তোলন নিয়ে এ মুহূর্তে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ সরকারের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের চেয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।