সিএমএসএমই আমাদের ভবিষ্যৎ; বাংলাদেশ ব্যাংক’র গভর্ণরের অভিমত

স্টাফ রিপোর্টার

প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংক-এর গভর্নর ফজলে কবির বলেন, কোভিড মহামারী ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সকল স্তরের জনগণের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যা মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু নীতিসহায়তার পাশাপাশি পণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, কোভিড মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিধিনিষেধ আরোপের কারণে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা পরিলক্ষিত হলেও আমাদের অর্থনীতি এখন ঘুঁড়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সুসুক বন্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা যাবে এবং এ ব্যাপরে বাংলাদেশে ব্যাংক পরবর্তীত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে যুগোপযোগী সিদ্ধন্ত গ্রহণ করবে।
তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের রপ্তানি বেশি মাত্রায় তৈরি পোষাকের উপর নির্ভরশীল, তবে কৃষি, ঔষধ, পাট, সিরামিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি সম্ভাবনাময় খাতকে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা প্রদানে এগিয়ে আসার পাশাপাশি মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে সকলকে মনোযোগী হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান আরো বলেন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ তহবিলের সম্প্রসারণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়বে, তবে নেগোশিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে সকলকে আরো মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি জানান, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষনে সহায়তা নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিডা’র সাথে একযোগে কাজ করছে। বিশেষ করে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার আরো উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় উল্লেখজনক হারে হ্রাস করা সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। কোভিড মহামারী মোকাবেলায় সকলকে একযোগে কাজ করার পাশাপাশি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি সিএমএসএমই খাতকে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি উল্লেখ করে এখাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সকলকে কাজ করার আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথি’র বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে দেশের কর কাঠামাকে সাময়িক সময়ের জন্য পুনঃবিন্যাস করার দাবী জানান, তা না হলে সামনের রমজান মাসে আরো ভোগান্তি বাড়বে বলে মত প্রকাশ করেন। শিল্পখাতে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে শিক্ষা ও শিল্পখাতের সমন্বয় আরো সম্প্রসারণের আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি। তিনি দেশের কৃষিখাতের উন্নয়নে কৃষিপণ্য প্যাকেজিং এবং লজেস্টিক ব্যবস্থাপনায় আরো মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। এছাড়াও এলডিসি উত্তোরণের পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের ঔষধ শিল্পকে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন। টেকসই পণ্য হিসেবে পাট হতে উৎপাদিত পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এ ধরনের পণ্য রপ্তানি আরো বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে, তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সাথে এসএমই উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ সম্পৃক্ত থাকায় এখাতের প্রতি আরো যত্নবান হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন এফবিসিসিআই সভাপতি। বিদ্যুৎ খাতে সরকারি পুরাতন শিল্পসমূহ, যেগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না, সেগুলোকে বন্ধ করার পাশাপাশি সিস্টেম লস কমানোর উপর আহ্বান জানান, যার মাধ্যমে বিদ্যুতের মূল্য ভোক্তাদের সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। তিনি জানান, দেশের লজেস্টিক খাতের উন্নয়নে ১২ বছরের জন্য একটি দীর্ঘময়োদী পরিকল্পনা প্রদানের লক্ষ্যে এফবিসিসিআই কাজ করছে, যা শীঘ্রই সম্পন্ন করে সরকারের নিকট উপস্থাপন করা হবে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীন নদীপথ ব্যবহার করা সম্ভব হলে, পণ্য পরিবহনের খরচ এক-তৃতীয়াংশ কমানো যেতে পারে এবং এ লক্ষ্যে নদীপথের সংষ্কারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়াও সিএমএসএমইদের জন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণ সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ বাংক’র নজরদারি আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন এবং এলডিসি উত্তোরনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারী থাকা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২১) বাংলাদেশের অর্থনীতির পথচলা বেশ আশাব্যঞ্চক, তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, নীতি-সহায়তা, মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি, লজেস্টিক অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সাপ্লাই চেইনে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য বলে মনে করেন, ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২১) বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন। ডিসিসিআই আয়োজিত আজকের ওয়েবিনারে বাংলাদেশ ব্যাংক-এর গভর্নর ফজলে কবিরও এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন যথাক্রমে প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।

ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান উক্ত ওয়েবিনারে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটের উপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন,কোভিড পরবর্তী সময়ে বিশ^ব্যাপী ভোগ্য পণ্যের সাপ্লাই চেইনের উপর বেশি মাত্রায় চাপ পড়ায় আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ও কাঁচামাল আমদানিতে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়, স্থানীয় বাজারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমতাবস্থায় বিশেষকরে নিত্যপ্রয়োজনয় পণ্যে আমদানিকারকদের ঋণ সহায়তা ও আমদানিকৃত পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক হ্রাস করা হলে, সাধারণ জনগন এ অবস্থা হতে মুক্তি পাবে বলে মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কোভিড মহামারীর কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, একই সাথে তৈরি পোষাকখাতের পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবনের জন্য উদ্যোক্তাদের আরো মনোযোগী হতে হবে।

ওয়েবিনারের নির্ধারিত আলোচনায়মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) সভাপতি মোঃ সাইফুল ইসলাম এবং ফরেন ইনভেস্টরস্ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)’র সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় অংশগ্রহণ করেন। ওয়েবিনারের সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা চেম্বারেরর ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আরমান হক।

এমসিসিআই সভাপতি মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, কোভিড মহামারীর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারের উচিত হবে ঘোষিত ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পুনঃমূল্যায়ন করা। তিনি রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য শিল্পখাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের উপর জোরারোপ করেন। এমসিসিআই সভাপতি জানান, সাভারের ট্যানার শিল্পে স্থাপিত সিইটিপি কে আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ার কারণে চামড়া খাতের উদ্যোক্তাদের বেশ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। হালকা প্রকৌশল এবং কৃষিখাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের উৎপাদিত পণ্যের ভ্যালু এ্যাড করা গেলে এখাতের রপ্তানি আরো বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের জন্য সর্বজন স্বীকৃত ক্রাডিট রেটিং নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেগোশিয়নে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়বে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতি খাতে প্রস্তাবিত দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং জনগনের জীবনযাত্রায় তা নেতিবাচক প্রভাব ফলবে, ‘গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ড’ এবং ‘এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড’-এর জমানো তহবিল ব্যবহারের প্রস্তাব করেন।

ফিকি’র সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, রিয়েল এস্টেট শিল্পের সাথে নির্মাণ, সার্ভিস, ফিন্যান্সিয়াল এবং ইন্স্যুরেন্স প্রভৃতি খাত জড়িত থাকায় এর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনের জন্য “ইজ অব ডুইং বিজনেস”-এর উপর আরো বেশি হারে গুরুত্ব প্রদানের পাশাপাশি বিদ্যমান কর হার যৌক্তিকভাবে কমানোর দাবি জানান ফিকি’র সভাপতি। আমাদের রপ্তানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে আসিয়ান অঞ্চলে ‘ইকো-সিস্টেম’র বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত হওয়া এবং ক্রেডিট গ্যারান্টি স্টিম-এর আওতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এলডিসি উত্তোরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের শিক্ষা খাতের যুগোপযোগীকরণ একান্ত অপরিহার্য। বৃহৎ শিল্পের জন্য এসএমই খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য এখাতের উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই।

মুক্ত আলোচনায় পিআরআই’র চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, বিশ্ববাজারের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্তা অত্যন্ত বেশি, যার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব আমাদের উপর পড়বে, এটাই স্বাভাবিক এবং এ অবস্থা উত্তরনে আমাদের কে প্রস্তুত হতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের তৈরি পোষাক খাত একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের উদ্যোক্তারা অনুসরণ করতে পারে। রেমিট্যান্স কে আমাদের রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ রপ্তানিতে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান, পিআরআই’র চেয়ারম্যান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *