প্রধানমন্ত্রীর কাছে এফবিসিসিআইয়ের চিঠি
অবকাঠামো খাতের মূল কাঁচামালের দাম গত কয়েক মাসে ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ অবস্থায় সরকার গৃহীত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন করতে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)।
সম্প্রতি এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। সরকারের ব্যবসাবান্ধব নীতির ফলে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকায় ব্যবসায়ীরা সফলভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন। তবে গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে বিশেষ করে গত এক মাসে অবকাঠামো খাতের মূল কাঁচামাল— রড, সিমেন্ট, পাথর, বিটুমিন, কপার, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদির মূল্য ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। যা নির্মাণশিল্পের ওপর অকল্পনীয় বিরূপ প্রভাব ফেলছে।’
‘বর্তমানে দেশের নির্মাণ ব্যয় এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঠিকাদারদের পক্ষে তাদের চলমান ও আসন্ন প্রকল্পগুলোর কাজ যথাযথ মান বজায় রেখে চুক্তিতে নির্ধারিত মূল্যে সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে দেশের নির্মাণখাত অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বিদেশি ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বেশিরভাগ স্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে গেলে তাদের অর্থায়ন করা দেশের ৯০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও খেলাপি ঋণের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘গত তিন মাস ধরে দেশের ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে অযৌক্তিকভাবে রড ও সিমেন্টের মূল্য বাড়িয়ে চলেছে। এই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি শুধু নির্মাণ ও আবাসন শিল্পের ওপরই বিরূপ প্রভাব ফেলছে তা নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমকেও ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। এফবিসিসিআই বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে প্রতিনিধিত্বকারী শীর্ষ সংগঠন হিসেবে সব সময় দেশের বেসরকারি খাতের উন্নয়নে কাজ করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি কখনই কোনো ব্যবসা বা ব্যবসায়িক সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়।’
‘কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করার আগে সেই পণ্যগুলোর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যবসাগুলোর লাভ-ক্ষতির কথাও বিবেচনায় রাখা উচিত। উল্লেখ্য, দেশীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও তারা তাদের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির পরবর্তী পরিণতির প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে দিনের পর দিন রডের দাম বাড়িয়ে চলেছে।’
এই অবস্থা বিবেচনায় দেশের নির্মাণখাতে চলমান অস্থিরতা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ একান্তভাবে কামনা করেছে এফবিসিসিআই। একই সঙ্গে নির্মাণখাত ও স্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে এফবিসিসিআই কিছু সুপারিশ জানিয়েছে।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-
>> বিদ্যমান ও আসন্ন সরকারি প্রকল্পগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন করার নিমিত্তে অনতিবিলম্বে যেকোনো দেশ থেকে রড আমদানির অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন।
>> দরপত্র জমা দেওয়ার পর আইনগত কোনো পরিবর্তনের কারণে যদি প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে তাহলে ঠিকাদারকে অবশ্যই সেই বর্ধিত ব্যয়ের সমমূল্য দিতে হবে। যেমন- এ বছর হঠাৎ করেই ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যে ব্যাপারে কোনো ঠিকাদারই দরপত্র জমা দেওয়ার আগে জানতেন না। সুতরাং, এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাকে অবশ্যই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
>> সরকারি কিংবা বিদেশি অর্থায়নকৃত সব চলমান, আসন্ন (চূড়ান্তের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্প) ও ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোতে মূল্যের তারতম্য বিষয়ক ধারা সংযুক্ত করা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ব্যালাস্ট বাংলাদেশে আনার পরিবহন খরচ ব্যালাস্টের মূল দামের ২ গুণ থেকে ৩ গুণ বেশি। তাই ব্যালাস্টের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কেবল এফওবি-এর ওপর প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
>> সরকার অর্থায়িত প্রকল্পগুলোতে বিদেশি দরপত্র দাতাদের অংশগ্রহণ জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত বড় ও জটিল প্রকল্প- যেখানে দেশের স্থানীয় ঠিকাদারদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে, কেবল সেই ধরনের প্রকল্পে বিদেশি দরপত্র দাতারা অংশ নিতে পারবে, সেক্ষেত্রেও তাদের বাধ্যতামূলকভাবে কোনো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জয়েন্ট-ভেঞ্চার গঠন করতে হবে।
>> সরকার অর্থায়িত প্রকল্পগুলোতে স্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারি কিংবা বিদেশি অর্থায়নকৃত সব দরপত্র যতটা সম্ভব ফিডিক নির্ভর হওয়া প্রয়োজন। প্রকল্পগুলোতে নগদ অর্থের প্রবাহ নিশ্চিত করতে ঠিকাদারদের সময়মত অর্থপ্রদানের কোনো বিকল্প নেই। প্রাপ্য অর্থ প্রদানে ৫৬ দিনের বেশি বিলম্বের ক্ষেত্রে ঠিকাদারকে বিলম্ব-সংক্রান্ত সুদও দেওয়ার বিধান থাকা প্রয়োজন।
>> নিয়োগকর্তার অদক্ষতা বা অদূরদর্শিতার কারণে ঘটা বিলম্বের জন্য ঠিকাদারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান সরকারি কিংবা বিদেশি অর্থায়নকৃত নির্বিশেষে সব দরপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
>> সরকারি কিংবা বিদেশি অর্থায়নকৃত সব দরপত্রে ১০ শতাংশ অগ্রিম অর্থ দেওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সব কনসালটেন্সি দরপত্রের শর্ত এমনভাবে আরোপ করতে হবে, যাতে বিদেশি কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশ নেওয়ার সময় কমপক্ষে একটি স্থানীয় কনসালটেন্সি কোম্পানিকে তাদের অংশীদার (সাব-কনসালট্যান্ট হিসাবে নয়) হিসেবে নিতে বাধ্য থাকে।