অর্থনৈতিক রূপান্তরের ভরকেন্দ্র ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক

স্টাফ রিপোর্টার

১৯৭১-৭২ অর্থবছরে সদ্য স্বাধীন ভঙ্গুর একটি দেশের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৬৩০ কোটি ডলার। সে অর্থনীতি এখন ৪০০ বিলিয়ন (৪০ হাজার কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। গত পাঁচ দশকে দেশের অর্থনীতির এ রূপান্তরে নেতৃস্থানীয় ও বড় ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে এখন ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দুই অংকের প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি এক দশকের মধ্যে অর্থনীতিকে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনাও রয়েছে। দূরদর্শী নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন ও অর্থনীতিকে আরো এগিয়ে নিতে সামনের দিনগুলোয় বড় ভূমিকা রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গতকাল বণিক বার্তা আয়োজিত ‘দ্বিতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২১’-এ এসব কথা বলেন বক্তারা। সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। সম্মানিত অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ড. আতিউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তা সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ নিয়েছে। সোস্যালি রেসপনসিবল ফাইন্যান্সিং (এসআরএফ), বাধ্যতামূলক কৃষিঋণ, শস্যের বহুমুখীকরণ, আমদানির বিকল্প সংস্থান ও এসএমইর জন্য বিশেষ ঋণ, এমএসএমই ফাইন্যান্স, গ্রিন ফাইন্যান্স, এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্স, পেমেন্ট ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশনসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিকে আজকের এ অবস্থানে নিয়ে আসতে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ। বেড়েছে শিক্ষার হার ও গড় আয়ু। পাঁচ দশকে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধন হয়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাতে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ২০৩৫ সাল নাগাদ আমরা পরিণত হব বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে ফজলে কবির বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। গত পাঁচ দশকে দেশের জিডিপির আকার ৪০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তা ৫০০ বিলিয়ন ডলারের সীমা অতিক্রম করবে। তখন এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৩ হাজার ডলারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ধারাবাহিক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। করোনা অতিমারীর বৈরী অবস্থার মধ্যেও ২০২১ সালে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশের বেশি। আমাদের প্রত্যাশা, ২০২২ সালে এ প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের পরিমাণ ৮০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। ১৪ কোটি ডলার থেকে বেড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। রফতানি থেকে আয় বেড়েছে ১০০ গুণেরও বেশি। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পোশাক উৎপাদনকারী দেশে। ৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন থেকে দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন টনে।

গভর্নর বলেন, চলমান করোনা মহামারী বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার সব ধাপ অতিক্রম করবে। স্বল্প আয়ের দেশ হিসেবে শুল্কছাড়সহ বাংলাদেশ যেসব সুবিধা পেয়ে আসছে, সেগুলো থাকবে না। দেশের সব মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলকে এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। অর্থনীতির এসব চ্যালেঞ্জ কঠিন, কিন্তু অনতিক্রম্য নয়। দূরদর্শী নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশের অতীত রেকর্ড খুব ভালো এবং এ দেশের মানুষ দেশকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

মূল অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়। সেখানে গত ৫০ বছরে দায়িত্ব পালন করা ১১ জন গভর্নরের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাদের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি তাদের গৃহীত বিভিন্ন নীতি-পরিকল্পনার তথ্য জানানো হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়াত সাবেক ছয় গভর্নরকেও বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।

সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, আগামী অর্থবছরের আমাদের অর্থনীতি হাফ ট্রিলিয়ন ডলারের হবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে তা ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতির এ ব্যাপ্তিকে ধারণ করা হচ্ছে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। ব্যাংক খাতের গভীরতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে আমাদের পরবর্তী প্রবৃদ্ধির ধারা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। একসময় সরকারিভাবে ১০০ টাকা বিতরণ করতে গেলে ২৫ টাকা খরচ করতে হতো। এখন সেটা কমে এসেছে ৭০ পয়সায়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকার বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে অর্থ সচিব বলেন, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি—দুটি ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা রাখতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা আরো বেশি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে চলমান কভিড মহামারী থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের ঘোষিত চারটি নীতি কৌশলের প্রধান দুটি—অর্থাৎ স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা ও বাজারে অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা রাখছে। এমন ভূমিকা পৃথিবীর অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি। সরকার ঘোষিত ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থসংস্থানের ৭০ ভাগই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, গত অর্থবছরে বিশ্বের ৪১টি শীর্ষ অর্থনীতির দেশের মধ্যে মাত্র আটটি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল। তার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথাযথ যোগসূত্র থাকার কারণে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের রাজস্ব খাত নিয়ন্ত্রক অর্থ মন্ত্রণালয় যদি একসঙ্গে কাজ না করে, তাহলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা দুরূহ হবে। গত পাঁচ দশকে দেশের উন্নয়নের একটি বড় কারণ হলো সরকারের রাজস্ব খাত, মুদ্রা খাত ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একসঙ্গে কাজ করেছে। ব্যাংক খাতে শেষ ১০ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় অর্জন অটোমেশন চালু। এতে ব্যাংকিং সেবাগ্রহীতাদের সময় বেঁচেছে এবং খরচও অনেক কমে এসেছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীরা দ্রুত তাদের ভাতা পাচ্ছেন। ফলে অপব্যয়-অপচয় কমেছে। লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়েছে। এছাড়া অন্য ব্যাংকে বিভিন্ন লাইসেন্সসহ সরকারের অন্যান্য ফি পরিশোধের সুযোগও তৈরি হয়েছে।

দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও টেকসই অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবদান তুলে ধরে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশ অচিরেই দুই অংকের প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, সামাজিক রূপান্তর ও সামগ্রিক উন্নয়নের অংশীদারদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যতম উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। অনেক সমস্যাসংকুল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আশার আলো হয়ে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটিকে আরো বেশি দেদীপ্যমান করার জন্য আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের মধ্যে গতকালের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কাজী ছাইদুর রহমান ও একেএম সাজেদুর রহমান খান। এছাড়া উপস্থিত ছিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক একেএম ফজলুর রহমান, একেএম মহিউদ্দিন আজাদ, আশীষ কুমার দাশগুপ্ত, দেবদুলাল রায়, মোহাম্মদ জাকির হাসান, নূরুন নাহার, ড. মো. হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক জিএম আবুল কালাম আজাদ, মো. জুলহাস উদ্দিন, ড. মো. এজাজুল ইসলাম, ড. সায়েরা ইউনুস, মোহা. আবদুল কাইউম, মোহা. আবদুল হালিম, বিষ্ণুপদ বিশ্বাস, রোকেয়া খাতুন, মোছা. নূর নাহার বেগম প্রমুখ।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ (রুমী) আলী, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত এবং যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ী ও এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ (ওবিই) অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার, এবি ব্যাংকের এমডি তারেক আফজাল, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের এমডি ফরমান আর চৌধুরী, ব্যাংক এশিয়ার এমডি মো. আরফান আলী, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন, এক্সিম ব্যাংকের এমডি ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী, আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ আলম সারওয়ার, মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি মো. আহসান-উজ জামান, মধুমতি ব্যাংকের এমডি মো. সফিউল আজম, ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি মো. মেহমুদ হোসেন, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, পূবালী ব্যাংকের এমডি শফিউল আলম খান চৌধুরী, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এমডি মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ, দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি এম রিয়াজুল করিম, সীমান্ত ব্যাংকের এমডি মুখলেসুর রহমান, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি মসিউল হক চৌধুরী, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের এমডি তারিক মোর্শেদ, সিটিজেনস ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ মাসুম ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার নাসের এজাজ বিজয় এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আরো উপস্থিত ছিলেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন, পূবালী ব্যাংকের সাবেক এমডি মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের এমডি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, বাংলাদেশের এ অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অবদান অনেক বেশি। আমি একটি কেস স্টাডি উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখতে চাই। এক ব্যক্তি ১১টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকই একমাত্র সরকারি ব্যাংক। ওই ব্যক্তি সব ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করলেও শুধু সোনালী ব্যাংকের বেলাতেই খেলাপি। আমার প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেলায় কেন এমন চরিত্র? পাশাপাশি বলতে চাই, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি আমাদের প্রাইভেট ব্যাংকগুলোও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে, তাই বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে আমাদের অভিভাবকের মতো নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ধন্যবাদ জানাই। আমার মনে হয়, সরকারের যেসব প্রকল্প চলমান আছে, বিশেষ করে আমাদের গর্বের জায়গা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এসব বাস্তবায়ন হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি আরো উন্নত হবে। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে ইসলামী ব্যাংক পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প কর্মসূচি পালন করছে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে দি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের এমডি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর আরেফিন বলেন, আমার ২৭ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে নানাভাবে কাজ করেছি। আতিউর স্যার ও ফজলে কবির স্যার—দুই গভর্নরের কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়েছি। কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বুঝেছি। উন্নয়ন অভিযাত্রায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবদান বা তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি আমরা ব্যাংকাররা খুব ভালো করে বুঝি। বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছে, বাংলাদেশের ৪১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, শিল্প খাত কিংবা রেমিট্যান্স, যা-ই বলি না কেন সব অগ্রযাত্রার প্রতিটি খাতের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও তদারকি আছে।

গত পাঁচ দশকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পটপরিবর্তনের নানা দিক তুলে ধরে মাসরুর আরেফিন বলেন, পাঁচটি দশককে ভাগ করা যায় এভাবে—’৭২-’৭৫ সাল বাংলাদেশ অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থার পুনর্গঠন পর্ব। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয়করণ অধ্যাদেশ জারি করার পাশাপাশি কৃষি ব্যাংক ও শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জোরেশোরে কৃষি ও শিল্প খাতে ঋণ প্রদান কার্যক্রম চালু করে অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্রয়াস শুরু হয়। এর পরই আসে ’৭৬-’৮৯ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব—বাজারমুখী ব্যাংক ব্যবস্থা প্রণয়ন পর্ব। এ সময় বেসরকারি খাতে নতুন করে ব্যাংক স্থাপন শুরু হয়, আর্থিক খাত সংস্কারের প্রাথমিক পর্যায়গুলো চিহ্নিত করার জন্য মানি ব্যাংকিং ও ক্রেডিট কমিশন গঠন করা হয়। এরপর আসে ১৯৯০-২০০০ সাল পর্যন্ত ১০ বছর। এ সময়টাকে আর্থিক খাত সংস্কারের সময় বলা যায়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এফএসসি প্রজেক্ট চালু করার পাশাপাশি সুদহার কাঠামো জনবান্ধব বা নিম্নমুখী করা, অগ্রাধিকার খাতগুলো চিহ্নিত ও ব্যাংক রিফর্ম কমিটি গঠনসহ উল্লেখযোগ্য সংস্কার কার্যক্রম করা হয়। এর পরের পর্ব ২০০১-০৮ সময়টাকে আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনার সুদৃঢ়করণ পর্ব হিসেবে উল্লেখ করতে চাই। এ সময় ব্যাংকের বেশকিছু নতুন পলিসি আসে। ২০০৯-১৭ সাল হলো ব্যাংক ব্যবস্থার ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার পর্ব। ২০১৭ থেকে বর্তমান সময়কে অর্থাৎ শেষ পর্বটিকে বলতে চাই আর্থিক খাতে জালিয়াতি প্রতিরোধ, গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা ও কভিড মোকাবেলার পর্ব।

এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন আইডিএলসি ফাইন্যান্সের এমডি এম জামাল উদ্দিন, আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের এমডি মো. মনিরুজ্জামান, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের এমডি খাজা শাহরিয়ার, লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের এমডি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চৌধুরী, লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) খন্দকার সাফফাত রেজা, লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্টসের সিইও ইফতেখার আলম, ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজের সিইও সুমন দাস ও হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের পার্টনার সাব্বির আহমেদ, সিটিব্যাংক এনএর হেড অব করপোরেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং বাংলাদেশ শামস জামান, সিটি ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও কান্ট্রি বিজনেস ম্যানেজার আশানুর রহমান প্রমুখ।

সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবদান ও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ সরবরাহ পরিস্থিতি টেকসই করা নিয়ে আলোচনা করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সংবাদপত্র শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন নোয়াবের সভাপতি এবং আইসিসি বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ কে আজাদ। তিনি বলেন, আমার গ্রুপে বর্তমানে ৬০ হাজারের বেশি জনবল নিয়োজিত রয়েছে। প্রতি মাসে শতকোটি টাকার বেতন-ভাতা আর ১৫ কোটি টাকার বেশি ইউটিলিটি বিল দিচ্ছি। তার পরও আমার সাকল্যে ব্যাংকঋণ ৩৫০ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক অবদান না থাকা সত্ত্বেও অনেকের ব্যাংকঋণ হাজার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এটি কীভাবে হচ্ছে, সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সঠিকভাবে তদারক করতে হবে। একক গ্রাহকের ব্যাংকঋণ নীতিমালা আছে। এ নীতিমালার অতিরিক্ত ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রস্তাব যায় এবং সেটি ঠিকই অনুমোদন হয়ে যায়। এটা বন্ধ করা গেলে খেলাপি ঋণ কমবে। সুদহারও আরো কমানো যাবে। ব্যাংকগুলোকে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে যদি অনেক বিষয়ে স্বাধীনতা দেয়া যায় তাহলে আরো কর্মসংস্থান হবে, অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পঋণে এখনো অনেক হয়রানি হয়। এটি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেয়া প্রয়োজন।

দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের মধ্যে এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ, এসিআই এগ্রিবিজনেসেসের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ফা হ আনসারী, ইলেক্ট্রো মার্ট লিমিটেড (কনকা-গ্রি) ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর নুরুল আফসার, ইস্পাহানির ডিজিএম মার্কেটিং দিদারুল হাসানসহ প্রমুখ।

সম্মেলনে গবেষক, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও ব্যাংকার ড. আরএম দেবনাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম জাহীদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. মো. আখতারুজ্জামান, অধ্যাপক ড. শাহ্ মো. আহসান হাবীব, ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী, ড. বরকত-ই-খুদা, মো. আবদুর রহিম, মো. আহসান উল্লাহ, আলী হোসেন প্রধানিয়া, অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, সোহেল মোস্তফা, সাখাওয়াৎ হোসেন ভূঁইয়া, আমিনুল ইসলাম আখন্দ ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার।

আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) নির্বাহী পরিচালক এম আনোয়ারুল করিম ও মো. সাঈদ আহমেদ।

বণিক বার্তার এ আয়োজনে প্রধান সহযোগী ছিল দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড। বিশেষ সহযোগিতায় ছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, থাকরাল ও লংকাবাংলা ফাইন্যান্স। গোল্ড স্পন্সর কনকা-গ্রি ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক (এআইবিএল)। সিলভার স্পন্সর ছিল ইস্পাহানি, বিকাশ, সাউথইস্ট ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসবিএসি), মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *