এলপি গ্যাসের সিন্ডিকেটেড দাম বৃদ্ধি

গত মাসেও সাড়ে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ছিল ১ হাজার টাকা। ৩০ কেজি ওজনের সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছিল সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০০ টাকায়। কোনো কোনো কোম্পানি এর চেয়ে কম দামেও এলপি গ্যাস বিক্রি করেছিল। কিন্তু ১ অক্টোবর থেকে ছোট-বড় সব সিলিন্ডারের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২৫০ এবং ৩০ কেজির সিলিন্ডার ৩ হাজার টাকায়।

দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে কোম্পানিগুলো বলছে, এতদিন তারা লোকসানে এলপি গ্যাস বিক্রি করত। লোকসান কমাতেই দাম কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে।

দেশে এলপি গ্যাস বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেড। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আক্তার হোসেন সান্নামাত বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দাম বাড়ানো হয়েছে। আমরা এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের বিপরীতে লোকসান দিয়ে আসছিলাম। এখন এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দর না বাড়িয়ে উপায় নেই। তার পরও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পুরোপুরি সমন্বয় করা হয়নি। এখনো আমাদের লোকসান হবে। তবে পরিমাণটা একটু কমে আসবে।

এলপি গ্যাসের হঠাৎ এ দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে দীর্ঘদিন ধরে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে হ্যাপি ফুড অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। পাইপলাইনের গ্যাস না পাওয়ায় সিলিন্ডার গ্যাস দিয়েই চলে রেস্টুরেন্টের যাবতীয় রান্নার কাজ। তবে এলপি গ্যাসের বড় সিলিন্ডারের দাম হঠাৎ ৫০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ ব্যবসায়ী।

রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক মো. মনির বলেন, খরচ ওঠাতে গিয়ে খাবারের দাম বাড়ালে কাস্টমার হারাতে হচ্ছে। কারণ আগে যে খাবার কাস্টমার ৮০ টাকায় খেতেন এখন তার দাম ১০০ টাকা করলে অনেকেই আসতে চাইবেন না।

সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিউ ইস্কাটন রোডের মামুন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক মো. মিলনসহ এলপি গ্যাসের অন্য ভোক্তারাও।

দেশে এলপি গ্যাস বিপণনকারী আরেক প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের নির্বাহী পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) মীর টিআই ফারুক রিজভী বলেন, গত কয়েক বছরে বাজারে অনেকগুলো কোম্পানি এসেছে। প্রতিযোগিতার কারণে সে সময় পণ্যের দাম বাড়াতে পারেনি কোম্পানিগুলো। এখন কিছুটা দর সমন্বয় হচ্ছে। এতে এলপি গ্যাস ব্যবসায় বড় বিনিয়োগের বিপরীতে লোকসানের ঝুঁকি কিছুটা হ্রাস পাবে।

গ্যাস সংকটের কারণে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এতে এলপি গ্যাসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে দেশে এলপি গ্যাসের চাহিদা বছরে তিন লাখ টন। ২০১৫ সালে দেশে মোট এলপি গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ ছিল দুই লাখ টন। তবে জ্বালানি বিভাগ বলছে, প্রকৃতপক্ষে এলপি গ্যাসের চাহিদা পাঁচ লাখ টনের মতো।

এলপি গ্যাসের এ চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ জোগান দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেড। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১২ কেজি ওজনের প্রতি সিলিন্ডার এলপি গ্যাসের মূল্য ৭০০ টাকা। ২০০৯ সাল থেকে এ দামেই এলপি গ্যাস বিক্রি করছে তারা।

তবে এলপি গ্যাসের চাহিদার ৯২ শতাংশই জোগান দিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে প্রায় ২০টি বেসরকারি এলপি গ্যাস কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানিগুলো নিজেদের মতো করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। তবে প্রতিটি কোম্পানিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছ থেকে লাইসেন্স নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

জি-গ্যাস ব্র্যান্ডে এলপি গ্যাস বিপণন করছে এনার্জিপ্যাক। এনার্জিপ্যাকের (জি-গ্যাস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলেন, সাড়ে ১২ কেজি ওজনের প্রতি সিলিন্ডারে অনেক কোম্পানিকে ১২০ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে হচ্ছিল। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পর এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে এ গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ইস্পাতের মূল্যবৃদ্ধিতে সিলিন্ডারের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। প্রতিযোগিতার কারণে এর সমান্তরালে গ্যাসের দাম বাড়ছে না।

এদিকে এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। এতে সিন্ডিকেট করে বাজারে প্রভাব ফেলছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। তারা যে দাম নির্ধারণ করছে, সে দামেই কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদবলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে কোম্পানিগুলো এলপি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি দাম কত বাড়তে পারে। আমরা যে কোম্পানিগুলোকে রেগুলেট করব, তার জন্য তো একটা নীতিমালা দরকার। কিন্তু এখন রেগুলেট করার মতো কোনো নীতিমালা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *