মাছ বাঁচাতে ডিএনএ বারকোডিং

গবেষকদের মতে পৃথিবীতে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মাছের প্রজাতি আছে এবং এর বৃহত্তর অংশের বসবাস সাগরের নোনা জলে। ভারতবর্ষের পৌরাণিকে বঙ্গোপসাগরের নাম দেয়া হয়েছিল ‘রত্নাগার’ এবং সেই রত্নাগারের প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বিশাল এই এলাকাটি পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়।

বঙ্গোপসাগরে আমাদের দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এটি সামুদ্রিক জীব বৈচিত্রের একটি আধার। পরিবেশের হুমকির কারণে ১৯৯৫ সালে এই দ্বীপকে বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সঙ্কটাপন্ন অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। এ দ্বীপের জলরাশির নিচে লুকিয়ে থাকা জীববৈচিত্রের প্রকৃত তথ্য ডিএনএ বারকোডিংয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং এই সংগৃহীত তথ্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ব্যবহার করা হবে।

বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে বার কোডিংয়ের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব মৎস্য সম্পদ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করলেও বাংলাদেশে তা ছিল না। বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের কাজ আরও আগে থেকে শুরু হলেও এদেশে সেন্টমার্টিনের মাছের জীববৈচিত্র্য নিরুপণে বাহ্যিক অঙ্গসংস্থানের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনার সঙ্গে ডিএনএ বারকোডিংয়ের ব্যবহার এবারই প্রথম।

সমুদ্রকে ব্যবহারের মাধ্যমে সারা পৃথিবী অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেলেও আমরা পিছিয়ে আছি। তার কারণ সাগর সম্পদ সম্পর্কে আমাদের ধারণার অভাব।

সাগরে আছে বৃহত্তম মৎস সম্পদ। এ সম্পদ ব্যবহার রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর সঠিক পরিচর্যার জন্য দরকার এসব মাছের সঠিক তথ্য। আর এ তথ্য সংগ্রহের জন্য মাছের প্রাজাতি নির্ণয়ে কাজ করছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের একটি গবেষক দল।

সনাতন পদ্ধতিতে আগে যে প্রজাতি গণনা করা হতো তা অনেক সময় ভুল হতো কারণ অনেক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আছে যাদের শারীরিক গঠন এবং রঙ পরিবর্তন হয়ে যায় বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। সনাতন পদ্ধতিতে মাছের রঙ, পাখনার আকার ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনার সাহায্য নিয়ে প্রজাতি নির্ণয় করা হতো। আবার অনেক মাছ দেখতে একরকম হলেও এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে যা ডিএনএ বারকোডিং পদ্ধতির মাধ্যমে সহজেই নিরুপণ করা সম্ভব। বিশেষ করে প্রবাল দ্বীপে বসবাস করা মাছে তা প্রায়শই দেখা যায়।

তাই প্রজাতি নির্ণয়ের সঠিক ধারণা পাওয়ার জন্য প্রথমবারের মতো ডিএনএ বারকোডিংয়ের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপের মাছের প্রজাতি সঠিকভাবে নিরুপণের কাজ শুরু করা হয় ২০১৭ সালের মে মাসে যা বর্তমানে প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই পদ্ধতিতে প্রজাতি নির্ণয় করলে মাছের জীবনচক্রে তাদের যে পরিবর্তন আসে তাতেও একটি প্রজাতির মাছ দুইবার গণনার সম্ভাবনা নেই।

এই গবেষণায় স্কুবা ডাইভিং করেও সাগরতলে সেন্টমার্টিনের বর্ণিল মাছ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ডিএনএ বারকোডিংয়ের মাধ্যমে ১২৫টি মাছের প্রজাতি নিরুপণ করা হয়েছে যার মধ্যে ২০টি নতুন প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে বাংলাদেশের জলসীমায়। সেন্টমার্টিনের নীল জলরাশিতে প্রবালকে ঘিরে বেড়ে ওঠা এবং বেঁচে থাকা বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের প্রজাতি নির্ণয়, তাদের বৈশিষ্ট্য, প্রজনন মৌসুম ও অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এখন বিশেষজ্ঞদের হাতে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের NATP-2 প্রকল্পের অর্থায়নে একটি উপ-প্রকল্পের আওতায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীবের নেতৃতে একটি গবেষক দল এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করছে। এই NATP-2 প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে USAID, World Bank এবং বাংলাদেশ সরকার।

এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব  ২০২০ সালে বাংলাদেশে মাছের চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় ৪৩ লাখ মেট্রিক টনে। কিন্তু জলাশয় বাড়ার কোনো উপায় নেই বরং বাস্তবতা হচ্ছে জলাশয় দিনে দিনে আরো কমে আসবে। ডিএনএ বারকোডিং প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি, প্রজনন ক্ষেত্র ও প্রজননকাল চিহ্নিত করে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এর উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *