আগাম করের চাপে শিল্প খাত

বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রভাবে তিন মাস ধরে স্থবিরতা চলছে শিল্প খাতে। উৎপাদন ও ব্যবসা   প্রায় বন্ধ থাকায় বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এ পরিস্থিতিতে কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানিতে আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি ছিল শিল্প উদ্যোক্তাদের। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও আগাম কর বহাল রাখার এ প্রস্তাব শিল্প খাতে আরো চাপ তৈরি করবে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থমন্দার প্রভাব আমাদের দেশেও প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত করের বোঝা বইতে না পেরে যদি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিরাট অংকের ব্যাংকঋণ এবং বেকারত্বের অভিশাপ আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মারাত্মক ব্যাহত করবে।

বাজেট ঘোষণার আগে আগাম কর প্রত্যাহার চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছিল চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিয়মিত পণ্য আমদানি করে। গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে গ্রুপটির একটি আমদানি চালান বাংলাদেশে এসে পৌঁছে। করোনা সংকটের মধ্যেও এসব কাঁচামাল খালাসের সময় আগাম কর বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছিল গ্রুপটিকে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বলেন, ২৬ মার্চ থেকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ থাকায় কারখানায় তৈরি পণ্য বিক্রি করতে পারছিলাম না। ফলে নগদ অর্থের সংকট দেখা দেয়।  আবার একই সময়ে আগাম কর বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারকে দিতে হয়। করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও আগাম করের অতিরিক্ত চাপে মারাত্মক মূলধন সংকটে পড়তে হয়েছে আমাদের।

চট্টগ্রামের ওই শিল্প গ্রুপটির অনুরোধে প্রতিষ্ঠানটির নাম ও ব্যবসার খাত উল্লেখ করছে না বণিক বার্তা। যদিও আগাম কর নিয়ে সমস্যায় পড়া একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয় তারা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব খাতের ব্যবসায়ীরা আগাম করের চাপে মূলধন সংকটের মধ্যে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। এসব শিল্প খাতের মধ্যে ইস্পাত, সিমেন্ট, সিরামিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, পাদুকা ও প্লাস্টিক খাতের নাম উল্লেখযোগ্য।

এ অবস্থায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ৪ শতাংশ হারে আগাম কর আদায় না করে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহকালে প্রযোজ্য উৎপাদন কর হিসেবে তা আদায় করার অনুরোধ জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে আগাম করের কারণে তাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে এবং অধিক সুদ প্রদান করতে হচ্ছে। একটি বড় অংকের পুঁজি এতে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, যা ব্যাংক ব্যবস্থায়ও চাপ সৃষ্টি করবে।

দেশের সব শিল্প খাতের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) তাদের বাজেট প্রস্তাবে আমদানীকৃত কাঁচামালের ওপর আরোপিত আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়েছিল।  কিন্তু  প্রস্তাবিত বাজেটে ১ শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ করার পর প্রতিক্রিয়ায় আবারো আগাম কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে বিসিআই।

বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধূরী (পারভেজ) বলেন, দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানি করার ক্ষেত্রে অগ্রিম করের পরিমাণ ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ ও অগ্রিম কর সমন্বয় করার জন্য দুই কর মেয়াদের পরিবর্তে চার কর মেয়াদে সমন্বয় করার সুযোগ দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। কিন্তু বিসিআই কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম কর প্রত্যাহ্যার করার প্রস্তাব করছে। ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আগাম কর বাবদ সরকারকে দিতে হয়। ফলে মূলধন সংকটে পড়েন উদ্যোক্তারা।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিভিন্ন খাতের ৮ কোটি ৪০ লাখ টনের বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ আমদানির বিপরীতে ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা অগ্রিম কর (এটি) আদায় করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ৭ হাজার ২৯২ কোটি টাকা বাণিজ্যিক আমদানিতে ও বাকি ৫ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা বন্ড সুবিধায় আনা পণ্যের বিপরীতে আগাম কর হিসেবে আগাম করের চাপে শআদায় হয়েছে।

আমদানিকারকরা বলছেন, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী আগাম কর সমন্বয়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সেই অর্থ সময়মতো ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে আগাম কর ফেরত দেয়ার বিধান থাকা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে টাকা ফেরত পান না তারা। ফলে ব্যবসায়ীদের মূলধন ঘাটতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।

এদিকে বাজেট ঘোষণার দিন থেকেই ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। স্টিল, সিমেন্ট, সিরামিকসহ সমগ্র শিল্প খাতভিত্তিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে মতামতের পাশাপাশি আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।

প্রায় সব খাতের শিল্পোদ্যাক্তাই একই দাবি জানাচ্ছেন। স্টিল শিল্প খাতের প্রতিনিধিরা বলছেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্টিল শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ওপর ৫ শতাংশ আগাম কর নির্ধারণের ফলে স্টিল শিল্প মালিকদের বিপুল অংকের টাকা আগাম দিতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে আগাম করের পরিমাণ মূল্য সংযোজন করের চেয়েও বেশি দিতে হয় বলে দাবি করেছেন স্টিল শিল্পোদ্যোক্তারা।

স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আগাম করের কারণে কোম্পানির চলতি মূলধন ব্লক হয়ে যায়। আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই আগাম কর পরিশোধ করতে হয়। এতে মিল মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। সরকার আগাম করের অর্থ ফেরত পাওয়ার সুযোগ রাখলেও তা ফেরত পেতে নানা হয়রানির সন্মুখীন হতে হয়। সে কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন স্টিল মিল মালিকরা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২০২০-২১ প্রস্তাবিত বাজেটে মাত্র ১ শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা যথেষ্ট নয়। কারণ স্টিল শিল্পে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে প্রচুর কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ২০১৯-২০ এর আগে আমদানির ওপর কোনো আগাম কর নির্ধারিত ছিল না। বর্তমান আর্থিক বছরে কভিড-১৯-এর কারণে যেখানে মূলধন সংকট চলছে, সেখানে আগাম করের প্রভাবে স্টিল মিল মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরই মধ্যে চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিলেই স্টিল বা ইস্পাত খাতে সম্ভাব্য লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে বছর শেষে খাতটিতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। করোনা-উত্তর সময়ের ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তাদের আর্থিক দুরবস্থা প্রশমনে আগাম কর প্রত্যাহার চেয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানোয়ার হোসেন বলেন, বাজেটের আগেই আমরা দাবি জানিয়েছিলাম আগাম কর প্রত্যাহার করার। তা বিবেচনায় নিয়ে ১ শতাংশ কমানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে আমরা আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। সরকার নিজেই চাইছে শিল্পোদ্যোক্তাদের হাতে টাকা পৌঁছাতে। অর্থাৎ শিল্পের মূলধন সংকটের বিষয়টি সরকার অনুধাবন করে। সেখানে সরকারি সংস্থার মাধ্যমে অগ্রিম কর নেয়ার যৌক্তিকতা নেই।

একই দাবি সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদেরও। বাজেটের আগেই আগাম কর প্রত্যাহারের দাবি তুলেছিলেন তারা। পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর বাবদ সরকারের কাছে পুঞ্জীভূত ৭৫০ কোটি টাকা ফেরত চেয়েছিলেন। বিসিএমএর প্রথম সহসভাপতি ও মেট্রোসেম সিমেন্টের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুহাম্মদ শহীদউল্লাহ বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আগাম কর আরোপ করা হয়। এর আগে কখনই আগাম কর ছিল না। বাজেটের আগে আমরা এ আগাম কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম। এখন প্রস্তাবিত বাজেটে ৫ বা ৪ শতাংশ যাই থাকুক কোনো পার্থক্য নেই। কারণ এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল আটকে থাকে। যেখানে কারখানা চালাতে পারি না, কাঁচামাল কিনতে পারি না, সেখানে আগাম কর অনেক বড় বোঝা। সিমেন্ট তৈরিতে আমাদের যত কাঁচামাল প্রয়োজন যেমন ক্লিংকার, জিপসাম, লাইম স্টোন, স্লাগ ও ফ্লাইঅ্যাশ সবগুলোর ক্ষেত্রেই আগাম কর দিতে হয়। ৪ বা ৫ শতাংশ না, এই কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি আমরা।

একই ধরনের মত প্রকাশ করছেন দেশের নির্মাণ খাতের অন্যতম উপকরণ সিরামিক খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, সিরামিক পণ্য প্রস্তুতকারকদের বহুদিনের দাবি আগাম কর প্রত্যাহারের বিষয়টি।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সচিব জাহেদি হাসান চৌধুরী বলেন, বাজেট প্রস্তাবে মতামত দেয়াসহ আরো আগে থেকেই আগাম করের বিষয়ে আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এর প্রভাবে নগদ টাকা আটকে যায়। আগাম করের অর্থ সমন্বয়ের সুযোগ থাকলেও দেখা যায় কাঁচামাল কিনতে হলেও তখন কারখানার হাতে টাকা থাকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *