কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ‘আত্মঘাতী’

ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ২০১৯ সালের সমাপ্ত বছরের জন্য কোনো ব্যাংকই ১৫ শতাংশের বেশি নগদ এবং নগদ ও বোনাস শেয়ার মিলিয়ে ৩০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত শেয়ারবাজারের জন্য আত্মঘাতী বলছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা তারই প্রমাণ। ব্যাংকের লভ্যাংশের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়ায় শেয়ারবাজারে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া কয়েকটি ব্যাংক ইতোমধ্যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, এটা এখন সমন্বয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও এক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে।

তাদের মতে, ব্যাংকের লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হয়নি। কারণ এক এক ব্যাংকের সক্ষমতা এক এক রকম। ব্যাংক তার সক্ষমতা অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করবে। এ লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সেক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক অনিয়ম করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

তারা বলছেন, ২০১০ সালের মহাধসের পর শেয়ারবাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ব্যাংক খাতের দুরবস্থা। একের পর এক ব্যাংকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ হিসেবে মাত্রাতিরিক্ত বোনাস শেয়ার দিয়েছে। এতে একদিকে ব্যাংকের শেয়ারের সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার সক্ষমতা কমেছে। যে কারণে কয়েক বছর ধরে বেশির ভাগ ব্যাংক লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অনেকটাই বোনাস শেয়ারনির্ভর হয়ে পড়ে। তবে ২০১৯ সালের সমাপ্ত বছরের জন্য সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংক ভালো নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দেয়ায়, ব্যাংকগুলো তার সুযোগ নেবে এবং বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, কোন যুক্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এটা করেছে তা আমার বোধগম্য নয়। তবে এক এক ব্যাংকের পরিস্থিতি এক এক রকম। সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ লভ্যাংশ কত হবে তা শর্ত দিয়ে নির্ধারণ করে দেয়া যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। আমি এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার পক্ষে নই।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেটা করতে পারে তা হলো মনিটরিং করা। একটি ব্যাংক যে লভ্যাংশ ঘোষণা করছে, তা তার আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে আছে কি-না, সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক খতিয়ে দেখতে পারে। কিন্তু এ ধরনের শর্ত আরোপ করা উচিত নয়। এর কারণে শেয়ারবাজারে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে আলোচনার দরকার ছিল।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত শেয়ারবাজারের জন্য ভালো হয়নি। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এখন তাদের আবার তা সংশোধন করতে হবে। এমন সিদ্ধান্ত নিলে তা আরও আগে নেয়া উচিত ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে, এটা তারই অংশ। এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে আলোচনার দরকার ছিল।

এ সময় মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের অভিমত তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দেয়া ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল ব্যাংক যে লভ্যাংশ ঘোষণা করছে তা নিয়মমাফিক হচ্ছে কি-না, সেটা পর্যবেক্ষণ করা। লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে অনিয়ম পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রজ্জাক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত শেয়ারবাজারের জন্য আত্মঘাতী। এর ফলে শুধু ব্যাংকের শেয়ারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা নয়, এটি সার্বিক শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালের সমাপ্ত বছরের জন্য ব্যাংকগুলো ভালো নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করছিল। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে এখন ব্যাংকগুলো তার সুযোগ নেবে এবং বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করবে। ফলে সার্বিক শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কী আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায়

প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ইতোপূর্বে গৃহীত Deferral সুবিধার অধীন নয় এমন বা ২০১৯ সালের জন্য কোনো Deferral সুবিধা গ্রহণ ব্যতিরেকে যে সব ব্যাংকের ২.৫ শতাংশ ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারসহ ন্যূনতম ১২.৫০ শতাংশ বা তার বেশি মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম, সে সব ব্যাংক তাদের সামর্থ্য অনুসারে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদসহ মোট ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে।

প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ইতোপূর্বে গৃহীত Deferral সুবিধার অধীন নয় এমন বা ২০১৯ সালের জন্য কোনো Deferral সুবিধা গ্রহণ ব্যতিরেকে যে সব ব্যাংকের ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারসহ ন্যূনতম ১১.২৫ থেকে ১২.৫০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম, সে সব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে তাদের সামর্থ্য অনুসারে সর্বোচ্চ ৭.৫ শতাংশ নগদসহ মোট ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে।

প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ইতোপূর্বে গৃহীত Deferral সুবিধার অধীন নয় এমন বা ২০১৯ সালের জন্য কোনো Deferral সুবিধা সম্পূর্ণরূপে সমন্বয় করা হলে যে সব ব্যাংকের ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারসহ ন্যূনতম ১১.২৫ শতাংশ বা তার বেশি থাকে সে সব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে তাদের সামর্থ্য অনুসারে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ নগদসহ মোট ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে।

প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ইতোপূর্বে গৃহীত Deferral সুবিধার অধীন নয় এমন বা ২০১৯ সালের জন্য কোনো Deferral সুবিধা সম্পূর্ণরূপে সমন্বয় করা হলে যে সব ব্যাংকের ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারসহ ন্যূনতম ১১.২৫ শতাংশের কম কিন্তু ন্যূনতম সংরক্ষিত মূলধন ১০ শতাংশ হবে সে সব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে।

কে কত লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে

ইতোমধ্যে তালিকাভুক্ত ছয়টি ব্যাংক ২০১৯ সালের সমাপ্ত বছরের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৩০ শতাংশ নগদ, ইস্টার্ন ব্যাংক ২৫ শতাংশ নগদ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১১ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ব্যাংক এশিয়া ১০ শতাংশ নগদ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং উত্তরা ব্যাংক ১০ শতাংশ নগদ ও ২৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

ব্যাংকের শেয়ার দামের চিত্র

তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ৮টির শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালু বা ১০ টাকার নিচে অবস্থান করছে। আরও ৯টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর কাছাকাছি অবস্থান করছে। শেয়ারের দাম ২০ টাকা বা তার বেশি আছে মাত্র ৯টির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *