জ্বালানি তেল ও ধাতুর বাজারে অশনিসংকেত দেখছে বিশ্বব্যাংক
নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। চাহিদা কমতে থাকায় এরই মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। টানা দরপতনের ধাক্কা সামলাচ্ছে স্বর্ণ বাদে বেশির ভাগ ধাতু। এ মন্দা পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে বজায় থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। চলতি বছর জ্বালানি তেলের গড় দাম আগের বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশের বেশি কমতে পারে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংস্থাটি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের মতে, বছর শেষে ব্যবহারিক ধাতুর বাজারে দরপতন ১৩ শতাংশে ঠেকতে পারে। খবর রয়টার্স ও মেটাল বুলেটিন।
বৈশ্বিক পণ্যবাজারে নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর শেষে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের গড় দাম দাঁড়াতে পারে ৩৫ ডলারে, যা আগের বছরে জ্বালানি পণ্যটির গড় দামের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কম। এমনকি গত অক্টোবরে প্রকাশিত সর্বশেষ পূর্বাভাস সংশোধন করে চলতি বছরের জন্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সম্ভাব্য গড় দামের প্রাক্কলন কমিয়েছে সংস্থাটি।
জ্বালানি তেলের বাজারে এ মন্দা ভাবের পেছনে মোটা দাগে দুটো কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রথমত, নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদা ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসা। দ্বিতীয়ত, ওপেক-নন ওপেক দেশগুলোয় অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাড়তি উত্তোলনের জের ধরে বাজারে পণ্যটির চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া।
জানুয়ারির শুরু থেকেই নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে চীন। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষকে ঘরবন্দি রাখতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এমন এক সময় দেশটি এ উদ্যোগ নেয়, যখন চীনজুড়ে নতুন বর্ষ আগমনের ছুটি চলছিল। এ পর্যটন মৌসুমে লকডাউন শুরু হওয়ায় মানুষ ও পণ্য চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। স্থবির হয়ে পড়ে উৎপাদন কার্যক্রম। ফলে কমতে শুরু করে জ্বালানি তেলের চাহিদা।
পরবর্তী সময়ে চীন ছাড়িয়ে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। মহামারীতে বিশ্বজুড়ে ৩০০ কোটির বেশি মানুষ কার্যত ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। বন্ধ রয়েছে চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন। এর জের ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা দৈনিক গড়ে তিন কোটি ব্যারেলের বেশি কমে গেছে।
একদিকে যখন চাহিদা কমছে, তখন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন কমানো হয়নি। জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক উত্তোলন হ্রাসের চুক্তি নিয়ে রীতিমতো সময়ক্ষেপণ করেছে ওপেক-নন ওপেক দেশগুলো। ফলে ক্রমহ্রাসমান চাহিদার বিপরীতে বাড়তি উত্তোলনে ভারসাম্য হারিয়েছে জ্বালানি তেলের বাজার। দেখা দিয়েছে রেকর্ড দরপতন। কমতে কমতে এক পর্যায়ে শূন্য ডলারের নিচে নেমেছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। অর্থাৎ, জ্বালানি তেল কিনতে গেলে ক্রেতাদের পণ্যের সঙ্গে উল্টো অর্থ দিয়েছে বিক্রেতারা। ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি আগে কখনই দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাংকের মতে, জ্বালানি তেলের বাজারকে এ ধাক্কা দীর্ঘমেয়াদে সামলাতে হতে পারে। আর এজন্যই চলতি বছর জ্বালানি পণ্যটির গড় দামে বড় পতন দেখা যেতে পারে।
এদিকে চলতি বছর ব্যবহারিক ধাতুর বাজারে ১৩ শতাংশ দরপতনের সম্ভাবনা দেখছে বিশ্বব্যাংক। তবে আপত্কালীন নিরাপদ বিনিয়োগ উৎস হিসেবে পরিচিত স্বর্ণের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি তুলনামূলক অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তবে মহামারীর কারণে লকডাউন চলমান থাকায় সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হয়ে কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষ খাদ্য সংকটে পড়তে পারে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাখতার দিয়োপ বলেন, বৈশ্বিক পণ্যবাজারের সম্ভাব্য টালমাটাল অবস্থা উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোকে সংকটে ফেলতে পারে। বিশেষত জ্বালানি তেলের রেকর্ড দরপতন মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার রফতানিকারক দেশগুলোর অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি করবে। এসব দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা আগের তুলনায় ভঙ্গুর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্ভাব্য এ সংকটময় পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার জন্য এখন থেকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এজন্য জ্বালানি খাতে বিদ্যমান ভর্তুকি ব্যবস্থা সংস্কার, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বাড়ানো, নিজস্ব শিল্প রক্ষায় গৃহীত সংরক্ষণবাদী নীতি সংস্কারসহ কয়েকটি কার্যকর উপায়ের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।