শিশুদের যক্ষ্মা

অনেকেই নিবন্ধের শিরোনাম দেখে ভাবতে পারেন এটাও আবার হয় নাকি। হ্যাঁ, শিশুদেরও হতে পারে যক্ষ্মা। সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৮.৭ মিলিয়ন মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। এদের প্রায় ৬ শতাংশই শিশু। যদিও বলা হচ্ছে, সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা গেলে এ হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ হতো। বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগী অনেক বেশি। বিশ্বে যক্ষ্মা প্রবণ ২২ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। প্রতিবছর ১০ লাখে ২২৫ জন নতুন করে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। দেশের ১০ লাখ মানুষের মধ্যে যক্ষ্মায় মোট আক্রান্ত  ৪১১ জন। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা হলো মাত্র ৩.১ শতাংশ। অথচ পাকিস্তান,আফগানিস্তানের মতো দেশে এ হার শতকরা ২৫ ভাগ। যে দেশে যক্ষ্মার সংক্রমণ এত বেশি সেখানে শিশু যক্ষ্মা রোগী এত কম হওয়ার কারণ কী? কারণ হলো সঠিকভাবে রিপোর্ট বা তথ্য সংগৃহিত হয় না। এ ছাড়া শিশুর যক্ষ্মা নিয়ে চিকিৎসকদেরও জানা শোনা অনেক কম। সাধারণ জনগণের তো আরো কম। বড়দের যক্ষ্মা রোগ নিয়ে যত আলোচনা হয় শিশুদের যক্ষ্মা ততটাই অন্ধকারে আছে। অনেকে মনে করে শিশুর যক্ষ্মা হয় না।

আইসিডিডিআরবি ২০০৮-০৯ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণের পরীক্ষা চালায়। এতে দেখা যায়, প্রতি ১০ লাখ শিশুর ৫২ জনই যক্ষ্মায় আক্রান্ত। যদিও এটি সারা দেশের চিত্র নয়, তারপরও দেশে যে পরিমাণ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত শিশুর ডাটা আছে তা যে নেহায়েত কম নয় তাই প্রমাণ করে।

যক্ষ্মা একটি জীবাণুবাহিত রোগ। মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিবারকুলোসিস নামক জীবাণু দিয়ে এটি ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি,কাশি,গল্প করা, গান করা এমনকি হাসির মাধ্যমে এর জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এ জীবাণু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির ফুসফুসে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফুসফুসে যে সংক্রমণ হয় তা ভালো হয়ে যায়। তবে জীবাণু অনেক দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবাণু পুরোপুরি ফুসফুসে বা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে হতে পারে মিলিয়ারি যক্ষ্মা বা মস্তিষ্কের আবরণীর যক্ষ্মা। এ দুটো খুবই মারাত্মক। এ ছাড়া জীবাণু বেশ কিছু দিন পর রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে শরীরে ছড়ায়ে পড়ে। হতে পারে হাড়, মস্তিষ্ক, লিম্ফনোড,অন্ত্র, জয়েন্টের যক্ষ্মা । এগুলো বলে এক্সটা পালমোনারি যক্ষ্মা বা ইপিটিবি।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো শিশু যদি যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসে তাহলে শতকরা ৩৫ ভাগ শিশু যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারে। এদের মধ্যে সংস্পর্শে আসার প্রথম বছরের মধ্যেই আক্রান্ত হয় শতকরা ৯৫ জন। কাজেই আমাদের দেশে যে পরিমাণ যক্ষ্মা রোগী আছে এবং যে পরিমাণ শিশু যক্ষ্মায় আক্রান্তের সংস্পর্শে আসে তাতে সহজেই অনুমেয় শিশু যক্ষ্মায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা কত বেশি!

গবেষণায় আরো দেখা গেছে এক বছরের কম বয়সী শিশু যদি যক্ষ্মা রোগীর সংস্পর্শে আসে তাহলে শতকরা ৫০ জনই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। ২-১০ বছর বয়সীদের এ সংখ্যা কমতে থাকে। ১০ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তের হার আবার বাড়তে থাকে।

শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণ বেশ কঠিন। তবে কিছু কিছু উপসর্গ দেখা দিলে যক্ষ্মা আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা যায়। পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায়। শিশু যক্ষ্মার উপসর্গগুলো হলো :

১. একনাগারে  দুই সপ্তাহের বেশি কাশি যা সাধারণ এন্টিবায়োটিকে সারছে না।

২. একনাগারে দুই সপ্তাহের বেশি জ্বর, যা টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া বা নিউমোনিয়ার কারণে নয়।

৩. তিন মাস ধরে শিশুর ওজন বাড়ছে না বা ওজন কমে যাচ্ছে।

৪. শিশুর খেলাধুলায় আকর্ষণ কমছে বা দিন দিন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।

৫. মারাত্মক অপুষ্টি এবং

৬. যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাহলো শিশুর পরিবারে বা আশপাশে যক্ষা রোগী থাকা।

উপরের যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে বা চিকিৎসককে দেখাতে হবে। শিশুর যক্ষ্মা নির্ণয় করা বেশ কঠিন। শিশুর কফে যক্ষ্মার জীবাণু বেশ কম থাকে তাই কফ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় না। আবার ছোট শিশুরা কফ ঠিকমতো দিতেও পারে না। আট বছরের বেশি শিশুদের কফ পরীক্ষা করা গেলেও এর কম বয়সীদের কফ ইনডাকশন করে বের করা যায়। ছোট শিশুদের পাকস্থলির রস পরীক্ষা করে যক্ষায় আক্রান্ত কি না নিশ্চিত হওয়া যায়। এ ছাড়া এমটি টেস্ট করেও ধারণা করা যায়। বুকের এক্সরে করেও নিশ্চিত হওয়া যায়। বড়দের বুকের এক্সরে-তে যেমন ক্যাভিটি পাওয়া যায় শিশুদের তেমনটা পাওয়া যায় না, তাদের থাকে ডিফিউজ ওপাসিটি। এক্সট্রা পালমোনারি যক্ষ্মায় আরো ভিন্ন ভিন্ন টেস্ট করার দরকার হতে পারে।

দেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা যাকে এমডিআর- যক্ষ্মা বলে দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটি মারাত্মক ধরনের যক্ষ্মা। এতে আক্রান্তদের দীঘর্মেয়াদি ওষুধ সেবন করতে হয়। চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে নতুনভাবে যক্ষ্মা আক্রান্তের ২.১ শতাংশ এমডিআর- যক্ষ্মা ও পূর্বে চিকিৎসা নিয়েছে এদের মধ্যে ২৮ শতাংশ। তাই শিশুরা এমন যক্ষা রোগীর সংস্পর্শে আসার কারণে এমডিআর- যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে।

যক্ষ্মার চিকিৎসা নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচলিত কথা হচ্ছে- ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এ কথার ভিত্তি নাই।’ আসলেও তাই। যক্ষ্মা চিকিৎসায় ভালো হয়, এটি সহজলভ্যও। দেশের প্রত্যেক এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে সরকারিভাবে এ ওষুধ দেওয়া হয়। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজেও ডটস কর্ণারের মাধ্যমে এ রোগের ওষুধ বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। এ রোগমুক্ত হতে প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা।

শিশুদের জন্যও সরকারিভাবে বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ওষুধ পানিতে গুলিয়ে সেবন করানো যায়। ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শমতো প্রতিদিন সেবন করাতে হবে। দেখা গেছে কিছুদিন ওষুধ সেবন করানোর পর শিশু সুস্থ হয়ে ওঠে। মা-বাবা ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেন। এটি কিন্তু খুবই মারাত্মক। এতে যক্ষ্মা তো সারেই না উল্টো মারাত্মক এমডিআর- যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় শিশু। এর ফলাফল হয় ভয়াবহ। অনেক অভিভাবক শিশুর ওপর ওষুধ সেবনের দায়িত্ব দেন। এটিও খারাপ হতে পারে। শিশু ওষুধ সেবন না করে ফেলেও দিতে পারে। তাই নিজে দায়িত্ব নিয়ে প্রতিদিনের ওষুধ প্রতিদিন সেবন করান।

অনেক গর্ভবর্তী, প্রসূতি, দুগ্ধদানকারী মা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারেন। এমনটি হলে গর্ভস্থ বা প্রসূত শিশু যক্ষ্মায় আক্রান্তের হার অনেক বাড়ে। এমন শিশুদের যক্ষ্মার উপসর্গ থাকলে চিকিৎসা দিতে হবে। যদি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর উপসর্গ নেই কিন্তু এমটি পজিটিভ তাহলেও চিকিৎসা দিতে হবে। যদি এমন শিশুদের উপসর্গ না থাকে; পরীক্ষা করেও যক্ষ্মায় আক্রান্ত ধরা না পড়ে তাহলে যক্ষ্মা প্রতিরোধে ছয় মাসব্যাপী ট্যাবলেট আইসোনিয়াজাইড সেবন করাতে হবে।

একটি জিনিস মনে রাখবেন, পরিবারে বা বাড়ির আশপাশে কারো যক্ষ্মা বা অনেক দিনের পুরনো কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তি থাকলে শিশু যক্ষ্মায় আক্রান্ত কি না তা নিশ্চিত হতে ভুলবেন না। যক্ষ্মার ব্যাপারে সচেতন হোন, ভালো থাকুন।

ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু, মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *