বিমানের দুর্নীতিবাজরা গ্রেফতার আতঙ্কে

বৈমানিক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে গত ২৫ নভেম্বর বিমানের সাবেক দুই এমডিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সর্বশেষ আজ (৩ ডিসেম্বর) বিমানের কার্গো শাখার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের এক মামলায় বিমানের সাবেক পরিচালক আলী আহসান বাবু ও ডিজিএম ইফতেখার হোসেন চৌধুরীকে গ্রেফতার করে দুদক।

এর আগে সকালে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এ গ্রেফতার দুজনসহ বিমানের ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক নাসির উদ্দিন। এদের সবাই এখন গ্রেফতার আতঙ্কে। বিমানের আউট স্টেশনগুলোতে কান্ট্রি ম্যানেজারদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

দুদকের মামলার আসামিরা হলেন- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (কার্গো) মো. আরিফ উল্লাহ, সৌদি আরবের কান্ট্রি ম্যানেজার মো. শহিদুল ইসলাম, সৌদি আরবের রিয়াদের রিজিওনাল ম্যানেজার আমিনুল হক ভূঁইয়া, সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. লুৎফর জামাল, সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মোশাররফ হোসেন তালুকদার, সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) রাজীব হাসান, সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) নাসির উদ্দিন তালুকদার, সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) অনুপ কুমার বড়ুয়া, সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব/বাণিজ্যিক) কেএন আলম, সহকারী ব্যবস্থাপক (আমদানি শাখা) ফজলুল হক, সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) সৈয়দ আহমেদ পাটওয়ারী, মনির আহমেদ মজুমদার, একেএম মঞ্জুরুল হক ও মো. শাহজাহান।

দুর্নীতি দমন কমিশন
দুর্নীতি দমন কমিশন

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুর্নীতিবাজ অফিসারদের বিরুদ্ধে এ অভিযান শুরু হয়েছে মূলত চলতি বছরের শুরু থেকে। বিমানের দুর্নীতিবাজ মাফিয়া চক্র ও গডফাদাররা যেন কোনোভাবে দেশত্যাগ করতে না পারেন সেজন্য এপ্রিল মাসেই দুর্নীতিবাজদের একটি তালিকা দিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ইমিগ্রেশন পুলিশকে সতর্ক করে দুদক।

এদিকে বিমানের দুর্নীতিবাজ কোন কর্মকর্তাই ছাড় পাবেন না বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মতো দেশের বিমান ও পর্যটন খাতে দুর্নীতি এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের কিছুতেই ছাড় দেয়া হবে না। দুর্নীতিবাজদের কোনো দল বা আদর্শ নেই। তাদের পরিচয় একটাই তারা দুর্নীতিবাজ।

তিনি বলেন, দেশের এভিয়েশন খাতে দুর্নীতি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী জিরো টলারেন্স অব্যাহত থাকবে।

গত ২৫ নভেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক আহমেদ ও ক্যাপ্টেন ফারহাত হাসান জামিলসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। পাইলট নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা করেন। অন্য দুই আসামি হলেন- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) বর্তমানে এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টারের অধ্যক্ষ পার্থ কুমার পণ্ডিত এবং ব্যবস্থাপক (নিয়োগ) ফখরুল হোসেন চৌধুরী।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক পরিচালনা পর্ষদ সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিমান এগোতে পারেনি শুধু দুর্নীতির জন্য। দুদকের তদন্ত গ্রেফতারে বোঝা যায় এতদিন বিমানে কি পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে। যাদের ধরা হয়েছে দোষী প্রমাণিত হলে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আউট স্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, আলী হাসান বাবুর গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তাদের রিজিওনাল ম্যানেজার কাউকে না বলে দুপুরে অফিস থেকে বের হয়ে যান।

ওই কর্মকর্তা জানান, মার্কেটিং বিভাগ থেকে রিজিওনাল ম্যানেজার হওয়া ওই কর্মকর্তাকে মনে হচ্ছিল অনেকটা আতঙ্কিত।

মার্কেটিং সেলস বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই দুর্নীতিবাজরা একরকম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অফিস করছেন। দুর্নীতিবাজ দুই শীর্ষ কর্মকর্তা গ্রেফতারের পর তাদের আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে।

গত ২৪ মার্চ বিমান বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স লিমিটেডের টিকিট বিক্রি ব্যবস্থাপনার নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় কার্যবিবরণীতে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। বৈঠকে দুর্নীতির ১০টি ধাপ উল্লেখ করে বিমান সচিব বলেন, বিমানের টিকিট বিক্রি কার্যক্রম সম্পূর্ণ অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবে সামান্য কিছু টিকিট অনলাইনে সচল রেখে বাকি টিকিট ব্লক করে রাখা হয়।

অথচ নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা দিলে টিকিট পাওয়া যায়। এভাবে টিকিট বিক্রি প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। অনেক সময় অনেক সিট খালি রেখে বিমান যাত্রা করে। দীর্ঘদিনের এমন অভিযোগ সামনে নিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও মন্ত্রণালয় ব্যাপক অনুসন্ধানে নামে। এর ভিত্তিতে টিকিট দুর্নীতির বহু প্রমাণিত তথ্য বেরিয়ে আসে।

এ বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন বিমানের বিভিন্ন ফ্লাইটে প্রায় ৮ হাজার টিকিট থাকে। এর মধ্যে চক্রটি টার্গেট অনুযায়ী সর্বনিম্ন দামের কয়েকশ টিকিট ব্লক করে রাখে। যেগুলো বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে বেশি মূল্যে বিক্রি করে। এভাবে তারা প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পকেটে ভরে। যেসব কর্মকর্তা এসবের সঙ্গে জড়িত তাদের সবার তালিকা করা হয়েছে। ধাপে ধাপে প্রত্যেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সিভিল এভিয়েশনে ১৯টি খাতে দুর্নীতি হচ্ছে। দুদক অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। দুদকের পর্যবেক্ষণে পাওয়া বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ ও সুপারিশ সংবলিত একটি প্রতিবেদন গত মার্চে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে হস্তান্তর করে কমিশন। এতে সরকারি লাভজনক বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে কীভাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে, তা-ও উপস্থাপন করা হয়। একইভাবে সম্পত্তি বেহাতসহ সিভিল এভিয়েশনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছে দুদক। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর দুর্নীতি বন্ধসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ভবিষ্যতে দুর্নীতি বন্ধেও কিছু সুপারিশ পেশ করে দুদক।

বিমান ক্রয় ও লিজ খাতে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বলা হয়, বিমানের অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ইকুইপমেন্টস, বড় অঙ্কের ক্রয় এবং বিমান লিজের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। কম্পিউটার-ইন্টারনেট সর্বস্ব কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ফার্ম এসব ক্রয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিমানের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার নামে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কিছু বোর্ড ডাইরেক্টরকে অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করে যোগসাজশে মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়। ইঞ্জিনের মেজর চেক সাইকেল, মেয়াদোত্তীর্ণ ইত্যাদি হিসাবে না নিয়ে বিমান লিজ নেয়ায় হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *