হাঁটু ব্যথার চিকিৎসা কী?

সাধারণত শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সেই হাঁটু ব্যথা হতে পারে। হাঁটু ব্যথার চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৪১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতালের প্রধান পরামর্শক ডা. এম ইয়াসিন আলী।

প্রশ্ন : হাঁটু ব্যথার সাধারণ কারণগুলো শুরুতে জানতে চাইছি।

উত্তর : হাঁটু ব্যথা খুব প্রচলিত একটি শব্দ। আমাদের বয়স চল্লিশের ওপরে হলে যেমন চুল পেকে যায়, এ রকম বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের একটি ক্ষয় হতে থাকে। হাড় ক্ষয় হওয়ার যে মূল কারণ, যাকে আমরা অস্টিওআর্থ্রাইটিস বলি, বেশির ভাগ রোগীই এ কারণে হাঁটু ব্যথা নিয়ে আসে, বিশেষ করে বয়স বেড়ে গেলে। তা ছাড়া কিছু রোগী আমরা পেয়ে থাকি, যেমন খেলার ক্ষেত্রে, ফুটবলার, ক্রিকেটার, হকি খেলোয়াড়—এদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লিগামেন্ট আহত হয়ে থাকে। খেলোয়াড়দের মূল ব্যথার কারণ ক্ষয়জনিত নয়, লিগামেন্টে আহত হওয়া জনিত। কিছু ছোট শিশুর রিউমেটিক ফিভার থাকে, তাদেরও হাঁটু ফুলে যায়, ব্যথা হয়।

প্রশ্ন : হাঁটু ব্যথার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির ভূমিকা কতটুকু রয়েছে, সেটি আমাদের একটু বুঝিয়ে বলেন?

উত্তর : হাড়ের ক্ষয়জনিত যে হাঁটু ব্যথা হয়, এ ক্ষেত্রে জয়েন্টের মধ্যে যে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড থাকে, সাধারণভাবে বললে গাড়ির চাকায় যে গ্রিজ থাকে, যেটা চাকাকে চলতে সাহায্য করে, এ রকম আমাদের জয়েন্টের ভেতরে যে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড থাকে, এটা আমাদের চলাচলকে সহজ করে দেয়, বিশেষ করে নিচে বসা। এটা সঠিকভাবে না করতে পারলে একজন রোগীর প্রতিদিনকার কাজ করতে অনেক অসুবিধা পোহাতে হয়। সে ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির ভূমিকা অনেক বেশি। বিশেষ করে তার গাঁটের জায়গাটা কমে যায়। তখন এখানে জায়গাটা বাড়ানোর জন্য ফিজিওথেরাপি রয়েছে। এটি খুব ভালো একটি চিকিৎসা। আমরা রোগীদের ম্যানুয়াল থেরাপি নিতে বলি। কিছু ব্যায়াম আছে, যেগুলো রোগীদের জায়গাটি বাড়ানোর ক্ষেত্রে কাজ করে, আমরা ম্যানুয়ালি সেটা করে দিই। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পা সোজা করলে সেখানেও কিছু পেশি জড়িয়ে থাকে। আমরা এই হাঁটু যদি সোজা করতে না পারি, সে ক্ষেত্রেও ব্যথা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পেশির শক্তিকে বাড়িয়ে দিতে হবে।

ডা. এম ইয়াসিন আলী।
প্রশ্ন : ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে পেশির শক্তি বাড়ানো কীভাবে সম্ভব?

উত্তর : এটি খুব সহজ পদ্ধতি। কিছু ব্যায়াম আছে, রোগী খুব সহজে করতে পারেন। এখানে কিছু শক্তি সঞ্চয় করার ব্যায়াম আছে, সেগুলো করাই। মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কিছু ব্যায়াম করাই। রোগী সহজেই এটি করতে পারেন। এর পর ধীরে ধীরে পেশির শক্তি বাড়ানোর জন্য আমরা কিছু ওজন দিয়ে থাকি। আরো কিছু পদ্ধতি রয়েছে, এগুলো দিয়ে খুব সহজে ব্যায়াম করা যায়।

প্রশ্ন : শিশুদের ক্ষেত্রে বলছিলেন, রিউমেটিক ফিভারের সময়  হাঁটুতে যে ব্যথা নিয়ে আসে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা কেমন থাকে?

উত্তর : এখানে রোগটির কারণে গাঁটগুলো ফুলে যায়। ফুলে যাওয়ার কারণে ব্যথা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে গরম ও ঠান্ডাথেরাপি রয়েছে, সেই থেরাপি দিলে ফোলা ভাবটা কমে যায়। পেশি নড়াচড়া না করার কারণে দুর্বল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু স্ট্রেটিক কোয়াড্রিসিভ স্ট্রেন্দেনিং ব্যায়াম করতে বলি। পাশাপাশি সে তো কিছু ওষুধ খাচ্ছেই, তার সমস্যাকে সারানোর জন্য।

প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, গাঁট নড়াচড়া করার জন্য জায়গা পাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে জায়গাটা আপনারা কীভাবে তৈরি করেন?

উত্তর : আমরা ম্যানুয়াল এক ধরনের ট্রাকশন ব্যবহার করি। ট্রাকশন মানে টানা, গাঁটের জায়গাটা বাড়িয়ে দেওয়া। তবে আমরা ট্রাকশন দিয়ে জায়গা বাড়িয়ে দিলাম, আবার আগের জায়গায় ফিরে এলো, তাহলে তো লাভ নেই। সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, তার পেশির শক্তিকে বাড়ানো যেন যাতে গাঁটের জায়গাটার শক্তি থাকে। এ জন্য মিলিত চিকিৎসা দরকার।

প্রশ্ন : কত দিন পর্যন্ত এই চিকিৎসা আপনাদের করতে হয়?

উত্তর : রোগের জটিলতার ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। আবার কিছু রোগীর ক্ষেত্রে একটু দীর্ঘ সময় লাগে। অনেকে দেখা যায়, অনেক দেরি করে আমাদের কাছে আসে।

প্রশ্ন : তাহলে কখন আসা উচিত, সেটি একটু জানতে চাই?

উত্তর : আসলে হাঁটু ব্যথার ক্ষেত্রে শুরুতেই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। কারণ, ব্যথানাশক ওষুধের তো অনেক ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমরা সাময়িকভাবে ওষুধ খেতে বলি। তবে দীর্ঘমেয়াদি খেলে লিভার, কিডনি এগুলোর অনেক ক্ষতি হতে পারে। এ জন্য সাময়িক প্রদাহ দূর করার জন্য এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ ব্যথার ওষুধ খেল, পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি শুরু করল। ব্যথার প্রথম দিন থেকেই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন : ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অনেক দিন ধরে নিতে হয় বলে এর প্রতি একটি অনীহা আমাদের মধ্যে থাকে, সেটি কেন?

উত্তর : আসলে অনেকে মনে করেন যে একটা ইনজেকশন দিয়ে দিলাম, ব্যথা কমে গেল, তাহলে কেন ১৪ দিন, ১৫ দিন ফিজিওথেরোপি নেব? আসলে হঠাৎ কোনো কিছুই ভালো নয়। আমরা যেটা মনে করি, হয়তো সাময়িকভাবে একটি ব্যথানাশক ওষুধ খেল ব্যথা কমে গেল, তবে তার যে সমস্যা এর তো কোনো সমাধান হলো না। মূল যে কারণে তার ব্যথা হচ্ছে, সেটিকে কমানো তার মূল কাজ। এ ক্ষেত্রে প্রথমে রোগীকে কাউন্সেলিং (পরামর্শ) দেওয়া জরুরি। বিশেষ করে তার রোগ সম্বন্ধে তাকে জানিয়ে দেওয়া। যে আপনার এই সমস্যা হয়েছে, এটি সারিয়ে তুলতে এ ধরনের চিকিৎসা লাগবে। অনেকের কাছে মনে হতে পারে, দুই সপ্তাহ কষ্ট করব? আসলে দুই সপ্তাহ কষ্ট করে যদি সারা জীবন ভালো থাকা যায়, এটার জন্য ত্যাগ করতে হবে।

প্রশ্ন : হাঁটু ব্যথার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রবীণ বয়সে অনেকে সার্জারি করার পরামর্শ দেন। সে ক্ষেত্রে সার্জারি করতে হয়, নাকি ফিজিওথেরাপি দিয়ে ভালো হয়ে যায়। আপনার মত কী?

উত্তর : এটি আসলে নির্ভর করছে রোগীর রোগের জটিলতার ওপর। কিছু কিছু ক্ষেত্র থাকে, যখন সার্জারি ছাড়া বিকল্প নেই। কিছু অবস্থা থাকে, ওখানে আর বদলানো ছাড়া উপায় থাকে না।

প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে সার্জারির পর কি ফিজিওথেরাপি কোনো ভূমিকা পালন করে?

উত্তর : আসলে অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে দুই জায়গাতেই ফিজিওথেরাপির ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে তার পেশির শক্তি ঠিক না থাকলে অস্ত্রোপচার করেও সে  হাঁটতে পারবে না। কারণ, ওখানে একটি কৃত্রিম ইমপ্লেন্ট লাগিয়ে দেওয়া হবে। তবে সম্পূর্ণ কার্যক্রম আগের মতোই রয়ে গেল। আগের মতো তার পেশির শক্তি যদি ঠিক না থাকে, সে হাঁটতে পারবে না।

প্রশ্ন : ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি আপনাদের পরামর্শ কী থাকে প্রাত্যহিক জীবনযাপনকে ঠিক করার জন্য, যাতে এ সমস্যা আবার না হয়?

উত্তর : এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজই থাকে, যেটা আমরা নিচে বসে করি, এটা একটু এড়িয়ে গেলে আমরা আরেকটু ভালো থাকতে পারি। প্রথমত, আমরা বলি ব্যথা থাকার সময় নিচে বসা, নামাজের মতো  বসা—এগুলো না করতে। টয়লেটে হাই কমোড ব্যবহার করা। যেখানে হাই কমোডের ব্যবস্থা নেই, সেখানে করে নেওয়া। আর যখন ব্যথাটা ঠিক হয়ে গেল, সে আবার আগের অবস্থানে চলে যেতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *