৫০০০ নারী কর্মী যুক্ত হবে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের টেলি মার্কেটিংয়ে
২০২৪ সালের শুরুর দিকের কথা। নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিশ্ববাজারে পণ্যের উপস্থিতি বাড়াতে মাত্র চারজন নারী কর্মী নিয়োগ দিয়ে ‘টেলি মার্কেটিং’ শাখা চালু করে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল। নারীরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে প্রাণ-আরএফএলের পণ্য বিপণনে কাজ করছেন।
টেলি মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২০২৪ সালে বিশ্ববাজার থেকে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ আনতে সক্ষম হয়েছে। নাটোর ও রাজশাহী অঞ্চলে তিনটি টেলি মার্কেটিং সেন্টারে বর্তমানে প্রায় ৭৫০ নারী কর্মী কাজ করছেন। তারা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পণ্য বিশ্ববাজারে ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরছেন। নিয়োগ পাওয়া নারী কর্মীরা ভালো করায় এ খাত নিয়ে আরও বড় স্বপ্ন দেখছে শিল্প গ্রুপটি। এজন্য টেলি মার্কেটিং খাতে ২০২৭ সালের মধ্যে পাঁচ হাজার নারী কর্মী নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।
ওয়াহিদা ইসলাম আশা কাজ করছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের টেলি মার্কেটিংয়ে। তিনি নাটোরের একডালায় নিজ জেলায় বসে কাজ করেন। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নেন টেলি মার্কেটিংয়ে।
কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে ওয়াহিদা ইসলাম আশা বলেন, ‘আমি মূলত সেলস অ্যান্ড সার্ভিস দুটোতেই কাজ করি। খুব ভালো লাগে এই কাজ। নিজের জেলায় বসে কাজ করছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ই-মেইলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এ কাজে ভাষাগত দক্ষতা বেশি জানা জরুরি।’
বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা বলতে পারেন ওয়াহিদা। টেলি মার্কেটিংয়ে মালয় ভাষারও প্রয়োজন হয়।
সুরভী ইসলাম নিহা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের টেলি মার্কেটিংয়ের কাজে যুক্ত আছেন এক বছর ধরে। তিনি নাটোরের একডালায় বসে মালয়েশিয়ার অংশটি দেখেন।
সুরভী ইসলাম নিহা জানান, গ্রাহকদের পণ্যসংক্রান্ত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেখেন তারা। ২৪ ঘণ্টাই ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে এখাতে কাজ করতে গিয়ে ভাষা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় তাকে। পরে মালয় ভাষা শিখে নিয়েছেন তিনি।
কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে সুরভী ইসলাম নিহা বলেন, খুবই ভালো লাগে তার এই কাজ।
টেলি মার্কেটিংয়ের যাত্রা নিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, সারাদেশে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন কার্যক্রমে লক্ষাধিক কর্মী কাজ করছেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, আন্তর্জাতিক বাজারে সরাসরি বিপণনকর্মী নিয়োগ দিতে না পারায় প্রাণ পণ্যের প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
‘আমরা চিন্তা করলাম যেসব জায়গায় সশরীরে যাওয়া যাচ্ছে না সেখানে কীভাবে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। এছাড়া সশরীরে গিয়ে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনায় অনেক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি অনেক ব্যয়বহুলও। তখন আমাদের মাথায় এলো টেলিফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি জায়গায় বসে বিদেশে যোগাযোগ সম্ভব। এক্ষেত্রে নারীদের যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজ এলাকায় কাজের সুযোগ দেওয়া যায় তবে তারা অনেক বেশি মোটিভেশনাল থাকবে। সেই চিন্তা থেকেই মূলত নারী কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করে টেলি মার্কেটিং খাতের চিন্তা আসে।’
কামরুজ্জামান কামাল বলেন, শুরুতে আমরা বিভিন্ন দেশের পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতার তথ্য সংবলিত একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছি। এরপর ২০২৪ সালের শুরুতে মাত্র চারজন নারী কর্মী নিয়োগ দিয়ে নাটোরে একটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করলাম। আমরা তাদের ভাষার দক্ষতার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত কিছু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বল্প পরিসরে বিদেশি কয়েকটি আউটলেটে পণ্যের ক্রয়াদেশ নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করতে নির্দেশ দিলাম। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সফলতা আসতে শুরু করায় এখন সেই চার নারী কর্মী থেকে প্রায় ৭৫০ নারী কর্মী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের টেলি মার্কেটিং পরিবারের অংশ। নিজ এলাকায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত টেলি মার্কেটিং সেন্টারে বসেই তারা এখন বিদেশে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
টেলি মার্কেটিং খাতের হেড অব অপারেশন মোহাম্মদ তানবীর হোসেন বলেন, সফলতা পাওয়ায় টেলি মার্কেটিং কার্যক্রমের পরিধি দ্রুত বাড়ছে। যেহেতু টেলি মার্কেটিং শুরু করার সময় আমাদের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল নারীদের নিজ এলাকায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। তাই আমরা নাটোরে কাজ শুরু করি যেন এ অঞ্চলের মেয়েরা কাজের সুযোগ পায়। এরপর আমরা রাজশাহী অঞ্চলে নারীদের কাজের সুযোগ দিতে রাজশাহী সদর ও গোদাগাড়ীতে আরও দুটি সেন্টার স্থাপন করেছি। নানা কারণে দেশের যেসব জায়গায় বিপণন কর্মী যেতে পারছেন না সেখানে টেলি মার্কেটিং সেন্টারের সহায়তা নিচ্ছি এবং সফলতা পাচ্ছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে টেলি মার্কেটিং সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। খুব শিগগির এসব জায়গায় কাজ শুরু হলে পাঁচ হাজারের বেশি নারী কর্মীর কাজের সুযোগ পাবে।
তানবীর হোসেন আরও বলেন, আমাদের টেলি মার্কেটিং খাতে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেই ভাষাগত দক্ষতা দিয়ে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। এখানে আয়ের খুব ভালো সুযোগ রয়েছে। আমরা তাদের যোগদানের সময় একটি নির্দিষ্ট বেতন নির্ধারণ করছি। এরপর তাদের কাজের দক্ষতা অনুযায়ী বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এতে একজন কর্মী মাসে সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্তও আয় করতে পারছেন।
যাত্রা শুরুর পর থেকে ২০২৪ সালে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ টেলি মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে এক বছরে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ বিশ্ব বাজার থেকে আনতে সক্ষম হয়েছে। দেশে বসেই প্রযুক্তি ও ফোনের সহায়তা নিয়ে এসব ক্রয়াদেশ এনেছেন নারী বিপণনকর্মীরা।
এ বিষয়ে মোহাম্মদ তানবীর হোসেন বলেন, নাটোরের একডালা কিংবা রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বসেই আমাদের নারী কর্মীরা বিদেশি দোকানগুলোতে যোগাযোগ করে পণ্যের অর্ডার নিচ্ছেন। পরে সেখানে প্রাণ-এর পরিবেশকদের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। বর্তমানে টেলি মার্কেটিংয়ে যে ক্রয়াদেশ আসছে তার প্রায় ৮০ শতাংশই আসছে বাংলাদেশের বাইরে থেকে। এজন্য আমরা নারী কর্মীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভাষাগত প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বর্তমানে টেলি মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে ১৬টি দেশে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইতালি, কুয়েত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, সৌদি আরব, নেপাল, মালদ্বীপ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
টেলি মার্কেটিংয়ের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে কামরুজ্জামান কামাল বলেন, বিদেশে একজন বিক্রয় প্রতিনিধির পেছনে ব্যয় অনেক। এছাড়া বিক্রয় প্রতিনিধিরা সশরীরে প্রতিদিন যে পরিমাণ দোকানে গিয়ে ক্রয়াদেশ আনতে পারেন একজন টেলি মার্কেটিংয়ের কর্মী সেখানে কেন্দ্রে বসেই তার চেয়ে তিন গুণ দোকান যোগাযোগের আওতায় আনতে পারেন। এ জায়গা থেকে টেলি মার্কেটিং বেশ সম্ভাবনাময়। বর্তমানে টেলি মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে বিপণন কার্যক্রমের প্রবৃদ্ধি হার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
তবে টেলি মার্কেটিংয়ের এগিয়ে যাওয়ার পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো চাকরি প্রত্যাশীদের বিভিন্ন ভাষার দক্ষতার অভাব। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য ইংরেজি ভাষার দুর্বলতার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ভাষা না জানা এ খাতের বড় সীমাবদ্ধতা।
এ বিষয়ে তানবীর হোসেন বলেন, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রচুর পণ্য ভারত, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। এসব জায়গায় কেরালা, তামিল, আরবি, মালয়ালাম ভাষার প্রচলন বেশি। মফস্বল এলাকায় একজন নারীর জন্য এসব ভাষা শেখা বেশ কষ্টসাধ্য। আমরা এখন নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীদের তৈরি করছি। তবে সরকারি পর্যায়ে ভাষার ওপর কোর্সের সুযোগ থাকলে অভিজ্ঞরা এ খাতে বেশি বেশি কাজের সুযোগ পাবেন।
‘দেশ থেকে বিদেশে ফোনকলের মূল্য অনেক বেশি যা আমাদের জন্য বড় বাধা। বিদেশে যোগাযোগের জন্য তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের যদি কম খরচে যোগাযোগের বিশেষ কোনো প্যাকেজের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’ বলে মনে করেন তানবীর হোসেন।