৩৬ কোটি টাকা ফাঁকি দিল টার্কিশ এয়ার
কার্গো হ্যান্ডেলিং চুক্তি থাকার পরও টার্কিশ এয়ারের কাছ থেকে আট বছরে ৩৬ কোটি টাকা হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায় না করার অভিযোগ উঠেছে বিমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। যাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এ অর্থ আদায় হয়নি তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমান কর্তৃপক্ষ।
ঘটনাটি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব জানার পর অনিয়মকারীদের শনাক্ত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, টার্কিশ এয়ার আগে নিয়মিত চার্জ দিলেও ২০১০ সাল থেকে এ খাতে সেবা নিলেও চার্জ দেয়া বন্ধ করে দেয়।
বিমানের কার্গো শাখার পাঠানো বিলের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালে টার্কিশ এয়ার থেকে আদায় করা হয়নি ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৫৮ মার্কিন ডলার; ২০১৭ সালে এ অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ৯ লাখ ৮৯ হাজার ১৫৮ মার্কিন ডলার; ২০১৬ সালে এ অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ১৯ হাজার ৫১৯ মার্কিন ডলার; ২০১৫ সালে আদায় করা হয়নি ৭ লাখ ৩৯ হাজার ২২৩ মার্কিন ডলার; ২০১৪ সালে আদায় হয়নি ৬ লাখ ২৯ হাজার ১৬৩ মার্কিন ডলার; ২০১৩ সালে আদায় করা হয়নি ৫ লাখ ৩ হাজার ৬৮৮ মার্কিন ডলার; ২০১২ সালে আদায় করা হয়নি ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮১৫ মার্কিন ডলার; ২০১১ সালে আদায় করা হয়নি ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩৫৯ মার্কিন ডলার এবং ২০১০ সালে আদায় করা হয়নি ৪ হাজার ৪৬৮ মার্কিন ডলার। সবমিলিয়ে আট বছরে ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৫ মার্কিন ডলার আদায় করা হয়নি। যা টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ৩৬ কোটি ১৪ লাখ ৩৮০ টাকা।
একই সময়ে নন-সিডিউল ফ্রেইটারের কাছ থেকে ইনবাউন্ড আউটবাউন্ড কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ ৭২০ কোটি টাকার উপরে লুটপাট হয়েছে। এ অনিয়মের বিষয়ে বিমানের অডিট আপত্তি তোলায় বিষয়টি গণমাধ্যমে আসে এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের উদ্যোগে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। দীর্ঘ ৪ মাস তদন্ত করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সচিবের কাছে জমাও দিয়েছেন তদন্ত কমিটি প্রধান যুগ্ম-সচিব জনেন্দ্র নাথ সরকার। চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল বলেন, ‘কার্গো হ্যান্ডেলিং চুক্তি থাকার পরও টার্কিশ এয়ার থেকে আট বছরে ৩৬ কোটি টাকার উপরে হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায় না করার ঘটনাটি আমি অবগত হয়েছি। টাকার অভাবে বিমানের অনেক কাজ নিয়মিত চালানো যাচ্ছে না। অথচ বিভিন্ন উৎসে কোটি কোটি টাকা অনিয়ম করে আদায় করা হয়নি। এসব অর্থ নিয়ম মাফিক আদায় করা হলে বিমানে টাকার অভাব থাকত না।’
তিনি বলেন, ‘বিমানের টিকিট বিক্রির অর্থ, কার্গো থেকে বিভিন্ন উৎসে আসা অর্থ আদায় নিয়মিত করতে আমরা নানামুখী পরিকল্পনা নিতে শুরু করেছি। আগের অনিয়ম তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
চুক্তি না থাকার অজুহাতে নন-সিডিউল ফ্রেইটারের কাছ থেকে ইনবাউন্ড আউটবাউন্ড কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ ৭২০ কোটি টাকার উপরে লুটপাট হয়েছে। অন্যদিকে কার্গো হ্যান্ডেলিং চুক্তি থাকার পরও টার্কিশ এয়ার থেকে আট বছরে ৩৬ কোটি টাকা হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায় করা হয়নি। এ অনিয়ম চলাকালীন কার্গো শাখার শীর্ষকর্তা সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসরে গেলেও সে সময়কার সব কর্মকর্তা কর্মচারী স্বপদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
বিমান অডিট শাখার হিসাব মতে, ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর এ হারে লুটপাট হয়েছে।
কীভাবে বছরের পর বছর এ অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাৎ করেছে? কোন কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতার কারণে এত বড় অনিয়ম হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, পরিচালনা পর্ষদ ও বিমান ম্যনেজমেন্ট তাহলে কী করে? এত বড় পুকুর চুরি বুঝতে কেন তাদের ১০ বছর লেগেছে? মন্ত্রণালয় শক্ত হাতে ধরার আগে কেন এতবড় অঙ্কের অর্থ টার্কিশ এয়ার থেকে আদায় করা হয়নি।
এমন প্রশ্নের জবাবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এএম মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, ‘টার্কিশ এয়ারের কাছ থেকে বকেয়ার বিষয়টি আমি ভালোভাবে জানি না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে আমি জানাব।’
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিমান ও সিভিল এভিয়েশন) মো. মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘চুক্তি থাকার পরও টার্কিশ এয়ার থেকে আট বছর হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায় না করার ঘটনায় আমরা আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করব। এ অনিয়মে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে আমরা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, নন সিডিউল ফ্রেইটারের কাছ থেকে ইনবাউন্ড কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক নন সিডিউল ফ্রেইটারের কাছ থেকে ‘স্লেভ রেট’ভিত্তিতে কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায় করা হয়। যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নন সিডিউল ফ্রেইটারের বহন করা ইনবাউন্ড এবং আউটবাউন্ড কার্গো হ্যান্ডেলিং বাবদ কোনো চার্জ বিমানের অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়নি।
কার্গো কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলে গত ফেব্রুয়ারি (২০১৮) থেকে এ চার্জ বিমানের কোষাগারে জমা হতে শুরু করে।
অডিট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ১০ বছরে উল্লেখিত খাত থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। শীর্ষকর্তারা অনেকে দুবাইতে ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।
বিমান ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে মনোনীত অডিটর বিগত বছরগুলোতে ওই চার্জ কোষাগারে জমা না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে নন সিডিউল ফ্রেইটার থেকে কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায়ের কোনো সার্কুলার নেই বলে জানায় কার্গো কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তীতে নিরীক্ষা তদন্তে ধরা পড়ে, ২০০৮ সালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কন্ট্রাক্ট শাখার টেলেক্সের মাধ্যমে জি-৯ এয়ারলাইন্সের ফ্রেইটারের ইনবাউন্ড এবং আউটবাউন্ড কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায়ের স্লেভ রেটভিত্তিক একটি তালিকা চট্টগ্রাম স্টেশন কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়েছে।
পাশাপাশি একই রেটে নন সিডিউল ফ্রেইটার থেকে কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায়ের জন্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কন্ট্রাক শাখা থেকে ই-মেইল করা হয়। যার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নন সিডিউল ফ্রেইটার থেকে কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ আদায় করছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিমানের অডিট শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, এ অর্থের হিসাব বের করতে কার্গোর সদ্য বিদায়ী মহাব্যবস্থাপককে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
তদন্তে দেখা গেছে, নন সিডিউল ফ্রেইটার সিল্ক ওয়ে ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নং-ইউ৩ ৭২২৫ (২৪ নভেম্বর ২০১৭) এর মাধ্যমে বহন করা ১৬ হাজার ৬৮৪ কেজি কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ বাবাদ দুই লাখ ৩৩ হাজার ৫২৯ টাকা (পেমেন্ট রশিদ নং- ১৫১৫৪৮), ৪ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে সিল্ক ওয়ে ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নং- ইউ৩ ৭২২৫ (১ ডিসেম্বর ২০১৭) এর মাধ্যমে বহন করা ১৮ হাজার ১০৭ কেজি কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ বাবাদ ২ লাখ ৫৩ হাজার ৯৯৫ টাকা (পেমেন্ট রশিদ নং- ১৫২৭৪৮) আদায় করেছে বিমান।
তবে গত ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত নন সিডিউল ফ্রেইটারে বহন করা ইনবাউন্ড ৫ কোটি ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৭০ কেজি এবং আউটবাউন্ড ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৮ কেজি মালামালের হ্যান্ডেলিং করে। এসব কার্গো হ্যান্ডেলিং চার্জ বাবদ বিমানের আয় হওয়ার কথা ছিল ৯০ লাখ ২৬ হাজার ৫৯৮ ডলার (প্রায় ৭৬ কোটি টাকা) যা আদায় করা হয়নি।