ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অনেক দেশের সঙ্গেই এফটিএ বা পিটিএ’র মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এ কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে। এক্ষেত্রে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শুল্ক আদায় তথা রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার ধাক্কা মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করার দরকার।
আয়কর:
১. এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, দেশে ইটিআইনধারীর সংখ্যা ৭০ লাখের মতো। এর মধ্যে আয়রক রিটার্ন দাখিল করেন মাত্র ২৪ থেকে ২৫ লাখ। অথচ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। রিটার্ন দাখিল না করা এ বিপুল পরিমাণ টিআইএনধারীকে কর নেটের আওতায় আনতে আইনের বাধ্যবাধতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতনা করা দরকার বলে আমরা মনে করি।
২. সিটি করপোরেশন এলাকার নাগরিকদের সর্বনিম্ন কর ৫ হাজার টাকা। করের এ পরিমাণটি কমিয়ে সব টিআইএনধারীকে কর প্রদানে উৎসাহী করা যায় কি-না আমরা তা ভেবে দেখার প্রস্তাব রাখছি।
৩. দেশের অর্থনীতির পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দশ বছরে বিপুল সংখ্যক মানুষ কর প্রদানে সামর্থ্যবান হয়েছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, এই মূহুর্তে দেশে করযোগ্য মানুষ অন্তত ২ কোটি। আবার কেউ বলছেন এই সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। করযোগ্য নাগরিকদের সংখ্যা নিয়ে এই বিভ্রান্তি দূর করতে কিংবা দেশে করযোগ্য প্রকৃত নাগরিকের সংখ্যা নিরুপণে এনবিআরের একটি ব্যাপকভিত্তিক জরিপ চালানো জরুরি বলে আমরা মনে করি। একইসঙ্গে তাদেরকে করের আওতায় আনতে সারাদেশের উপজেলা পর্যায়ে এনবিআরের কার্যক্রম বাড়ানো দরকার বলেও আমরা মনে করি।
৪. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংসদে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। কিন্তু এনবিআরে আয়কর জমা দেন মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার বিদেশী নাগরিক। দেশে কর্মরত বিদেশীরা বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায় বলে এক গবেষণায় জানিয়েছে টিআইবি। বিদেশী নাগরিকদের করের আওতায় আনতে এনবিআারের উদ্যোগ আরও জোরালো করার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
৫. বর্তমান আইন অনুযায়ী কাঁচামাল বা পণ্য আমদানির সময় ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে উৎসে কর কাটা হয়। এটি পরবর্তীতে সমন্বয় করে এনবিআর। তবে পণ্য বিক্রি করে কর সমন্বয়ের আগ পর্যন্ত ব্যবসায়ীর বড় আকারের মূলধন আটকে যায়। আমরা কর আদায়ের বিরোধিতা করছি না। তবে এভাবে ব্যবসার মূলধন আটকিয়ে না রেখে অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে কর আহরণ করা যায় কি না, তা ভাবতে এনবিআরকে পরামর্শ দিচ্ছি। একইসঙ্গে কোনো ব্যবসায়ী যেনো কর ফাঁকি দিতে না পারেন সেজন্য এনবিআরের অটোমেশন ও কঠোর মনিটরিংয়ের সুপারিশ করছি।
৬. অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল পদ্ধতিকে আরও জনপ্রিয় করতে ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা চালানো দরকার বলে আমরা মনে করি।
৭. জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েব সাইটটি আপগ্রেড করার প্রস্তাব করছি। এতে অনেক হালনাগাদ তথ্য ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। একইসাথে রাজস্ব বোর্ডের গবেষণা সেলটি আরও কার্যকর ও যুগোপযোগি করার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। আমাদের প্রস্তাব হলো-একজন সদস্যের নেতৃত্বে গবেষনা ও পরিসংখ্যান বিভাগকে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
৮. দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমান টাকা পাচার হচ্ছে, এই পাচার রোধে ২০১৩ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে একটি আইন করা হয়েছিল। বাস্তবে এর অগ্রগতি কতটুকু সেটা আমরা জানি না। মুদ্রা পাচার রোধে ভারত অথবা দক্ষিন কোরিয়ার মত কঠোর আইন করা যায় কি-না সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।
৯. বিনিয়োগকারিদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কর কাঠামো প্রনয়ণ করা যেতে পারে। এটি হলে উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
১০. আমরা জানি আয়কর নিয়ে একটি আইন হচ্ছে। এ আইনটি আধুনিক এবং সহজবোধ্য ভাষায় হচ্ছে। তবে আইনটির খসড়া হওয়ার পরপরই দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার। আমাদের সুপারিশ থাকবে আইনটি বাস্তবায়নের আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসে তাদের মতামতের ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত করা হবে। এটি হলে নতুন আইনটি নিয়ে কারো অভিযোগ এবং আপত্তি থাকবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।
১১. আমরা মনে করি-কাঠামোগত সমস্যা বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। এ দূর্বলতা কাটিয়ে কাঙ্খিত রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পুর্নগঠন জরুরি। এক্ষেত্রে দু’টি প্রস্তাব বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
ক. প্রথমত, ভারতের মত ডাইরেক্ট ট্যাক্স এবং ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স নামে দু’টি বিভাগ গঠন করা যেতে পারে। দুই বিভাগে দুইজন সচিব নিয়োগ করা হবে। অথবা একটি রেভিনিউ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এর একজন প্রধান কমিশনার থাকবেন, যার অধীনে অন্য কমিশনাররা থাকবেন। সরকার তাদের নিয়োগ দেবে।
বাজেট প্রস্তাবনা : ভ্যাট ও কাস্টমস
১২.বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে এনবিআর আইনি কাঠামোয় পরিবর্তনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এ খাতে অনিয়ম রোধ এবং আরও রপ্তানিবান্ধব বন্ড ব্যবস্থাপনা তৈরির জন্য এনবিআরের নেয়া বন্ডেড ওয়্যারহাউজ অটোমেশন প্রকল্পের কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে পুরো প্রক্রিয়াকে অটোমেশনের আওতায় আনা দরকার বলে আমরা মনে করি।
১৩. এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের সমন্বয়ে একটি ট্যারিফ কমিশন পলিসি করা হয়েছে। তবে ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষমতা শুধু এনবিআরের। কোন খাতের জন্য ট্যারিফ কেমন হবে, কিভাবে রেশনালাইজ করা উচিত তা আউট লাইন করা রয়েছে ওই পলিসিতে। আমাদের স্থানীয় শিল্পের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কি কি সুবিধা দেয়া উচিত তা নির্ধারণ করে ট্যারিফ পলিসিটি দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করছি।
১৪. রপ্তানিতে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের সফলতা অসামান্য। এর পেছনে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ডেড সুবিধাসহ নানা ট্যারিফ সুবিধা। রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্য সম্ভাবনাময় খাত যেনো তৈরি পোশাক শিল্পের মতো নিয়মিত বন্ডেড সুবিধা পায় আমরা সে সুপারিশ করছি।
১৫. একই এইচ এস কোড এ মাল্টিপল ট্যারিফ রয়েছে। এক ট্যারিফের পণ্য অন্য পণ্যের এইচ এস কোডে আমদানি করতে গেলে ব্যবসায়ীরা অনেকক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। অনেক সময় শুল্ক কর্তৃপক্ষের স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়। আমাদের সুপারিশ হলো-প্রতিটি পণ্যের জন্যই আলাদা এইচ এইচ কোড নির্ধারণ করা হোক।
১৬. ব্যবসায় পরিবেশ সহজ করা এবং এনবিআরের কার্যক্রমকে অটোমেশন করতে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো করার উদ্যোগ রয়েছে এনবিআরের। ২০২২ সালে এটির উদ্বোধন হওয়ার কথা। আমরা প্রত্যাশা করবো এ কাজটি যেনো নির্ধারিত সময়েই শেষ করে এনবিআর।
১৭. বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, সারাদেশে খুচরা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২ মিলিয়নের বেশি। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বড় অংশই কমপ্ল্যায়ন্ট নয়। স্বভাবতই তাদের বড় অংশ ভ্যাট দেয় না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভ্যাটের আওতায় আনার সুপারিশ করছি। পাশাপাশি খুচরা ব্যবসায়ীদের ভ্যাট, পণ্য মূল্যের ওপর নির্ধারণ না করে সংযোজিত মূল্যের ওপর নির্ধারণ করা দরকার বলে আমরা মনে করি। কারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা ভ্যাট রিফান্ড পান না।
১৮. ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে ইএফডির ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উপর গুরুত্ব দেয়ার সুপারিশ করছি।
১৯. পরিবেশবান্ধব বা সবুজ শিল্পায়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এনবিআর সাধারন কারখানা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পের মধ্যে কর্পোরেট করের ব্যবধান কমপক্ষে ৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব কারখানায় অতিরিক্ত বিনিয়োগের তুলনায় বিদ্যমান ২ শতাংশ কর সুবিধা অপ্রতুল বলে মনে করছে অনেকে।
২০. বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে বোতলজাত পানির উপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক শিথিল করা যায় কি-না সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে।
# জেলা শহরের বাইরে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উৎসাহ প্রদানে ওই বিনিয়োগকে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া।
# সরকার রাজস্ব কাঠামোর পরিবর্তনে যেসব সিদ্ধান্ত নেয় (শুল্ক-কর কমানো কিংবা বাড়ানো) তা পরবর্তীতে কী ধরণের প্রভাব ফেলে, তার একটি দক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। যাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর ও শুল্ক ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়, তারা যদি সুবিধা না পায়, সেক্ষেত্রে ঐ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন সময় নিত্যপন্যে করছাড় দেওয়া হলেও অভিযোগ রয়েছে, ভোক্তা পর্যায়ে তার সুফল যায় না সেটা দেখার দরকার। এনবিআরের দেওয়া সুবিধার প্রকৃত ফল সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নের লক্ষ্যে একটি দক্ষ ও শক্তিশালী বিভাগ তৈরির প্রস্তাব করছি। এছাড়া আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিষয়ক অনেক সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী, ভোক্তা, করদাতা কিংবা রাজস্বের উপর কী প্রভাব ফেলছে, তা বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে সংশোধনমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
# ডিজিটাল অর্থনীতির যেহেতু দ্রুত বিকাশ ঘটছে, তাই এই খাতকে করের আওতায় আনার সুপারিশ করছি।