১২৬ টাকায়ও রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ব্যাংক
দেশে আবারো অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে ডলারের বাজার। ব্যাংক খাতের পাশাপাশি খুচরা বাজারেও (কার্ব মার্কেট) ডলারের বিনিময় হার এখন বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর ঘোষিত দর অনুযায়ী, প্রতি ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ হওয়ার কথা ১২০ টাকা। যদিও এ ব্যাংকগুলোর কোনো কোনোটি এখন রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ১২৬ টাকা দরে। আর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার কেনাবেচা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১২৫ টাকায়।
গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে ডলারের বাজার প্রায় স্থিতিশীল হয়ে এসেছিল। ব্যাংকের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর ছিল নিম্নমুখী। চাহিদা কমে যাওয়ায় কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১২১ টাকায় নেমে গিয়েছিল। কিন্তু নভেম্বরের শুরুতেই ডলারের দর বাড়তে শুরু করেছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএফ) শর্ত অনুযায়ী বছরের শেষে নির্ধারিত পরিমাণে রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ন্যূনতম ১ হাজার ৫৩২ কোটি বা ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। এ শর্ত পূরণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনা বাড়ানোর বিষয়টিও মার্কিন মুদ্রাটির বিনিময় হার ঊর্ধ্বমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এর পাশাপাশি ডলারের দর স্থিতিশীল রাখতেও তৎপরতা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশি দরে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে, এমন বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এমডিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে তলব করা হয়েছে।
দেশে ডলারের চাহিদা এখন বেশ বেড়েছে বলে জানালেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওভারডিউ হয়ে যাওয়া সব ঋণপত্রের (এলসি) দায় ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণে কিছু ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে হলেও এলসি দায় সমন্বয় করছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে জ্বালানি তেল-এলএনজিসহ বেশকিছু বড় এলসি খেলা হয়েছে। আবার আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলাও বেড়েছে। এসব কারণে ডলারের দর এখন ঊর্ধ্বমুখী।’
আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স হাউজগুলো সিন্ডিকেট করে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আগে ছোট ছোট রেমিট্যান্স হাউজ থেকে আমরা ডলার কিনতে পারতাম। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে বড় এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ছোটগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনে নিচ্ছে। এরপর বড় এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ডলারের বিনিময় হার নিয়ে দরকষাকষি করছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বেশি দরে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছে। সর্বশেষ কর্মদিবসে প্রতি ডলারের দর ১২৫ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্তও উঠেছে। আর ব্যাংকে দর বৃদ্ধির প্রভাব এখন কার্ব মার্কেটেও দেখা যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, টানা দুই অর্থবছর আমদানি ঋণাত্মক ধারায় চলার পর চলতি অর্থবছরে আবারো প্রবৃদ্ধির ধারা ফিরে এসেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশের আমদানি ব্যয় হয়েছে ২২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। নভেম্বর ও চলতি ডিসেম্বরে আমদানির এলসি খোলা আরো বেড়েছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি কমেছিল ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কমেছিল। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি দেখানো হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে আমদানির আড়ালে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতার কারণে ২০২২ সাল থেকেই ডলারের বাজারে অস্থিরতার সূচনা হয়। এর পর থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা চলছে। গত তিন বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে ৪২ শতাংশেরও বেশি। ২০২২ সালের শুরুতেও দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত দর অনুযায়ী প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দর ১২০ টাকা। তবে এ দরে ব্যাংকে ডলার মিলছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে ডলারের বাজার সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল ছিল। ওই সময় কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দর ১৩০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। আর ব্যাংক খাতে ডলারের দর উঠেছিল সর্বোচ্চ ১২৫ টাকায়।
চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স। জুলাই থেকে নভেম্বর—এ পাঁচ মাসে প্রবাসীরা ১১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। আর জুলাই থেকে অক্টোবর—এ চার মাসে রফতানিতে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রেমিট্যান্স ও রফতানিতে বড় প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ডলারের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিন বছর ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে আমদানি দায় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ডলার দিয়ে আমদানি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ওভারডিউ হয়ে যাওয়া এলসি দায় ও জ্বালানি খাতসহ অন্যান্য খাতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর পাওনাও পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমদানিতে ছাড়ও দিতে হচ্ছে। এসব কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে।’
তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বণিক বার্তাকে জানান, ‘আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বেশ তৎপর। এজন্য বৈদেশিক বাণিজ্যে ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আমাদের ব্যাংককে ১০ মিলিয়ন ডলার জোগান দিতে বলা হয়েছে। এ কারণে বেশি দরে রেমিট্যান্স কিনে হলেও ডলার সংগ্রহ করছি।’
বাজার স্থিতিশীল রাখার কথা বলে টানা তিন অর্থবছর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি বা ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়নে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় আরো ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।
টানা তিন অর্থবছর ধরে ডলার বিক্রির কারণে রিজার্ভে বড় ধরনের ক্ষয় হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়নে)। সে রিজার্ভ কমে এখন ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) গত ১১ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। যদিও আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর নিট রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ জানান, ‘এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে ডলারের চাহিদা বেশ তীব্র। গত জুলাইয়ে গণ-আন্দোলন ও সরকারের পতনকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা অনেকটাই থমকে গিয়েছিলেন। এখন অনেকেই নতুন করে ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরু করেছেন। আবার রমজানকে কেন্দ্র করে খেজুর, ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বেড়েছে। জ্বালানি খাতেও বড় কিছু এলসি খোলা হয়েছে। ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসবের ভূমিকা আছে।’
এদিকে দুই সপ্তাহ ধরে কার্ব মার্কেটেও ডলারের দাম বাড়ছে। মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় এখন প্রতি ডলার বেচাকেনা হচ্ছে ১২৫ টাকারও বেশি দরে। রাজধানীর মতিঝিল ও কারওয়ান বাজার এলাকার বেশি কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তারা জানান, নভেম্বরের শুরুর দিক থেকেই খুচরা বাজারে ডলারের দর ঊর্ধ্বমুখী। তবে ডিসেম্বরে এসে চাহিদা তীব্র হওয়ায় দাম আরো বেড়েছে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশ থেকে ডলার নিচ্ছেন। আবার নতুন করে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন, এমন নেতাকর্মীরাও ডলার সংগ্রহ করছেন। এমনিতেই বছরের শেষের দিকে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী পর্যটক বিদেশ ভ্রমণ করেন। কার্ব মার্কেটে ডলারের দরবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসবেরও প্রভাব রয়েছে।