১১ কোটি ৮১ লাখ ৯১ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক
দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে যন্ত্রাংশ আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু এ সুবিধার অপব্যবহার করে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক লিমিটেড সরকারকে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৯১ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে এনবিআরের তদন্তে উঠে এসেছে।
এয়ারকন্ডিশনার (এসি) উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি পাওয়ার মূল শর্ত ভঙ্গ করে প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ সুবিধা গ্রহণের প্রমাণ পেয়েছে এনবিআরের মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির মূসক অব্যাহতি সুবিধা বাতিলের জন্য সম্প্রতি এনবিআরকে চিঠিও দিয়েছে মূসক গোয়েন্দা বিভাগ। আর এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে মূসকনীতি শাখার মতামত জানতে চেয়েছে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা, তদন্ত ও পরিদর্শন শাখা।
এনবিআর সূত্র জানায়, মিনিস্টার হাই-টেক পার্কের বিরুদ্ধে দুই ধরনের অভিযোগ ছিল। প্রথমত, মূসক অব্যাহতি সুবিধার জন্য পালনীয় শর্ত (উৎপাদনের জন্য মেশিনারি স্থাপন) পরিপালন না করা। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য প্রক্রিয়ায় মূসক ফাঁকি। তাই দুই ধাপে এসব অভিযোগের তদন্ত পরিচালনা করা হয়।
প্রাপ্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের তদন্ত দল প্রতিষ্ঠানটির গাজীপুর ও ময়মনসিংহের কারখানা এবং কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ে আকস্মিক পরিদর্শন করে। পরিদর্শনকালে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় অধিকতর তদন্তের জন্য কোম্পানির বিভিন্ন দলিল জব্দ করা হয়।
তদন্তের প্রথম ধাপে বলা হয়েছে, এসি উৎপাদনের জন্য যেসব মেশিনারিজ প্রতিষ্ঠানে আবশ্যিকভাবে থাকার শর্তে কোম্পানিটিকে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হয়েছে, সেসব মেশিনের মধ্যে ১৪টিই কারখানায় স্থাপন করা হয়নি। আকস্মিক পরিদর্শনকালে তদন্ত দল কোম্পানিটির কারখানায় এয়ারকন্ডিশনার উৎপাদনসংশ্লিষ্ট মেশিনারিজের অস্তিত্ব দেখতে পায়নি। অর্থাৎ তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এয়ারকন্ডিশনার অন্তর্ভুক্ত নেই।
এনবিআর প্রতিষ্ঠানটির আমদানি তথ্য যাচাইকালে দেখতে পায়, উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানির পরিবর্তে এয়ারকন্ডিশনারের তৈরীকৃত ইনডোর ও আউটডোর ইউনিট আমদানি করা হয়েছে। একইভাবে মূসক-১৬ যাচাই করেও এটা প্রমাণ হয়, প্রতিষ্ঠানটি কোনো এসি উৎপাদন করেনি। পুরো ইনডোর ও আউটডোর ইউনিট আমদানির পর কেবল স্ক্রুয়িংয়ের মাধ্যমে সংযোজন করে অন্যান্য এসি সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের মতোই বাজারে সরবরাহ করছে।
তদন্তের দ্বিতীয় ধাপে বলা হয়েছে, আমদানীকৃত উপকরণ মূসক-১৬ রেজিস্টারে এন্ট্রি না করিয়ে ৬ কোটি ৮৬ লাখ ১২ হাজার ৯১৫ টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক। এ ফাঁকির বিষয়টি স্বীকারও করে কোম্পানিটি। এছাড়া এয়ারকন্ডিশনারের ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি সুবিধা নিয়ে উপকরণ আমদানি পর্যায়ে ২ কোটি ৯৮ লাখ ২৩ হাজার ৬৬৬ ও স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ১ কোটি ৯৭ লাখ ৫৪ হাজার ৮১২ টাকাসহ মোট ৪ কোটি ৯৫ লাখ ৭৮ হাজার ৪৭৭ টাকা মূসক ফাঁকি উদ্ঘাটন হয়েছে তদন্তে।
সূত্র জানায়, সব মিলিয়ে মূসক অব্যাহতি সুবিধায় কোম্পানিটি মোট ১১ কোটি ৮১ লাখ ৯১ হাজার ৩৯২ টাকা মূসক ফাঁকি দিয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে কোম্পানিটি ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। সুদ ছাড়া বাকি ৮ কোটি ৮১ লাখ ৯১ হাজার ৩৯২ টাকা আদায়ের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
মূসক গোয়েন্দা, নিরীক্ষা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএফএম আবদুল্লাহ খান এ বিষয়ে বলেন, কোম্পানিটির বিরুদ্ধে করা তদন্তে মূসক অব্যাহতি সুবিধা অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এর মাধ্যমে তারা সরকারের মূসক ফাঁকি দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে এনবিআর কোম্পানিটিকে মূসক অব্যাহতি সুবিধা দিয়েছে। তাই এনবিআরের অধীন কোনো দপ্তরের এ অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করার আইনগত সুযোগ নেই। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য কোম্পানিটির বাস্তব অবস্থা এনবিআরকে জানানো হয়েছে।
ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার অপব্যবহার বিষয়ে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এমএ রাজ্জাক খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেননি। পরে তার ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বলে জানান। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিটির অডিট বিভাগের কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বণিক বার্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
মো. হাসানুজ্জামান বলেন, গত বছর এনবিআরের তদন্ত দল আমাদের কারখানা পরিদর্শন করে। আর ওই সময় আমাদের কারখানার এসি উৎপাদনকারী মেশিনারিজগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাই এনবিআরের তদন্ত দল সেগুলো দেখতে পায়নি। তবে মূসক অব্যাহতি সুবিধার শর্তে উল্লেখ করা মেশিনারিজ বাইরে নিতে হলে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন লাগে। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। বর্তমানে আমাদের মেশিনগুলো কারখানায় রয়েছে। তাছাড়া শর্ত অনুযায়ী যেসব মেশিনারিজ প্রয়োজন, তার বেশকিছু অপ্রয়োজনীয়। তাই এগুলো আমরা স্থাপন করিনি। চলতি বছর এসির কাঁচামাল বা যন্ত্রাংশ আমদানি করা যায়নি। তাই এসি উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
মূসক ফাঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মূসক-১৬ চালানে আমরা যথাযথ এন্ট্রি দিইনি। বিষয়টি আমরা স্বীকারও করেছি। তবে তৈরি এসি আমদানির অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন।
এদিকে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক গাজীপুরের কারখানা পরিদর্শনেও এনবিআরের তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। কারখানাটি পরিদর্শনে দেখা যায়, বর্তমানে গাজীপুরের কারখানায় এসি উৎপাদন করা হয় না। এমনকি সেখানে এসি উৎপাদনের জন্য মেশিনারিজও নেই। ওই কারখানায় বর্তমানে শুধু ফ্রিজ, টেলিভিশন ও গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদন করা হয়।
কারখানার একাধিক শ্রমিক ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, সাত-আট মাস আগে এ কারখানায় এসি তৈরি হতো। তবে এখন হচ্ছে না। মেশিনারিজগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মেশিনারিজগুলো কোথায় জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা বলেন, এগুলো অনেক আগেই ময়মনসিংহের কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে এসি তৈরি হয় বলে জানান তিনি। কোম্পানিটির কারখানার ফটকে মিনিস্টার মাইওয়ানের পাশাপাশি রাজস্ব বোর্ডের বড় সাইনবোর্ড লাগানো আছে।