হোটেল ব্যবসায় ধস, পর্যটন খাতে বড় ধাক্কা

স্টাফ রিপোর্টার

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে সরব বিরোধী দলগুলো। নিয়মিত বিরতিতে চলছে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। বিশেষত, রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল, অবরোধ আর সহিংস কর্মকাণ্ডে দেশের আবাসিক হোটেলগুলোর ব্যবসায় এখন চরম মন্দা। বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় কমছে পর্যটকের সংখ্যা। সব মিলিয়ে ধস নামতে শুরু করেছে হোটেল ব্যবসা ও পর্যটন খাতে।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ ঘুরে এবং সেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে কয়েক সপ্তাহ ধরে যে উত্তাপ-উত্তেজনা বিরাজ করছে তারই প্রভাব পড়েছে আবাসিক হোটেল ব্যবসায়। ঢাকার আবাসিক হোটেলগুলোতে বুকিং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। এতে ভরা মৌসুমের শুরুতেই লোকসানের শঙ্কায় পড়েছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, এখন পর্যটনের মৌসুম। আবার বছরের শেষভাগে নানা সামাজিক ও করপোরেট অনুষ্ঠানের সময়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটনের এই মৌসুমেও দেশের আবাসিক হোটেলগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অনেক কম। দেশে শিগগির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফিরলে তাদের লোকসানের বোঝা আরও বাড়বে।

রাজনৈতিক অঙ্গনের চলমান পরিস্থিতিতে হোটেল মালিকরা যেমন লোকসানে পড়বেন, পাশাপাশি এ খাতের কর্মচারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ব্যবসায় ধস নামায় অনেক হোটেল মালিক বাধ্য হয়ে কর্মচারীদের ছুটি দিচ্ছেন। অনেকে ঠিকমতো বেতন দিতে পারছেন না
ঢাকার গুলশানে অভিজাত হোটেল দ্য ওয়েস্টিন। স্বাভাবিক সময়ে হোটেলটির লবিতে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। তবে বিরোধী দলগুলোর সাম্প্রতিক অবরোধকালীন সেখানে গিয়ে জনাকয়েক মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ে। অথচ বছরের এই সময় হোটেলটিতে দেশি-বিদেশি প্রচুর অতিথির যাওয়া-আসা হয়। এখন যারা রয়েছেন তাদের অধিকাংশই অতি জরুরি কাজে এসেছেন, তাদের মধ্যে পর্যটকের সংখ্যা একেবারেই কম।

কথা হয় ওয়েস্টিনের প্রটোকল ম্যানেজার নাজিমুল হুদার সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার খুব বেশি প্রভাব পড়েছে আমাদের ব্যবসায়। অন্য বছর এসময় শতভাগ বুকিং থাকতো, এখন সেটা কমে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশে নেমেছে। পিক সিজনে এ পরিস্থিতি চরম সমস্যায় ফেলেছে।

বিভিন্ন হোটেলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, ঢাকার আবাসিক হোটেলগুলোতে বর্তমানে দেশি-বিদেশি পর্যটকের উপস্থিতি একদম কম। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় হোটেল ব্যবসার ভরা মৌসুম ধরা হয়। এসময় গড়ে অন্তত ৯০ শতাংশ রুম বুকিং থাকে। হরতাল-অবরোধ আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় এবার তা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।

রাজধানীর আরেক অভিজাত হোটেল আমাজন লিলি লেক ভিউ রেসিডেন্স। হোটেলটির ম্যানেজার খন্দকার এএসএম জাকারিয়া বলেন, অন্য সব ব্যবসারও খারাপ অবস্থা। সেজন্য করপোরেট কাস্টমার কম। তাদের মতো আমরাও ভুগছি। হরতাল-অবরোধে মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বাইরে থাকতে চাচ্ছে না। সেজন্য হোটেলগুলোতে বর্ডার/অতিথি কমে গেছে।

শুধু প্রথম সারির এমন অভিজাত হোটেলগুলোই নয়, রাজধানীর পল্টন ও আশপাশের এলাকার মধ্যম ও নিম্নসারির সাধারণ আবাসিক হোটেলগুলোও এখন অনেকটাই ফাঁকা। সেসব এলাকার একাধিক হোটেল ঘুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি হোটেলের অধিকাংশ কক্ষই ফাঁকা। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি হয়রানির ভয়েও মানুষ সেখানকার আবাসিক হোটেলগুলো এড়িয়ে চলছেন।

বেশকিছু হোটেলে দু-একদিন পরপর পুলিশ আসছে। কড়াকড়ি আগের থেকে বেড়েছে। ফলে অনেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়াতে হোটেলে আসছেন না। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত সহিংস ঘটনা ঘটছে। এসব কারণে মানুষ উদ্বিগ্ন
সেগুনবাগিচায় তোপখানা রোডের আবাসিক হোটেল কর্ণফুলীতে গিয়ে দেখা গেছে, হোটেলটিতে ৩৫টি কক্ষ। বর্তমানে সেখানে রয়েছেন মাত্র ১০ জন অতিথি। গত বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় হোটেলের ম্যানেজার সেলিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কিছু বর্ডার ছিল। ১৯ ও ২০ নভেম্বর (রবি ও সোমবার) আবার হরতালের খবরের পর পুরো হোটেল ফাঁকা হয়ে গেছে।

হরতাল-অবরোধে হুমকিতে পর্যটন খাত

তিনি বলেন, মানুষ এখন ঢাকায় এসে কী করবে। কোথাও কোন কাজ করা যাচ্ছে না। কর্মদিবসগুলোতে লাগাতার হরতাল বা অবরোধ দেওয়া হচ্ছে।

পল্টন মোড়ের কাছে অভিজাত আবাসিক এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টেরও একই অবস্থা। সেখানে ৫৪টি কক্ষের মধ্যে অর্ধেকই খালি। এ হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্ক অফিসার জমশেদ হুসাইন বলেন, সবাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। যাদের ঢাকায় আসা খুব প্রয়োজন, তারাও এসময় কম আসছেন। বিদেশি গেস্টের সংখ্যাও একেবারে কম।

তিনি বলেন, আমাদের এখানে ব্যবসায়ী ও মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক গেস্ট বেশি থাকেন। তারপরও এখন ফাঁকা। রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরে থেকে কেউ আসছেন না।

বিভিন্ন হোটেলের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশকিছু হোটেলে দু-একদিন পরপর পুলিশ আসছে। কড়াকড়ি আগের থেকে বেড়েছে। ফলে অনেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়াতে হোটেলে আসছেন না। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত সহিংস ঘটনা ঘটছে। এসব কারণে মানুষ উদ্বিগ্ন।

তবে কোনো দুর্বৃত্ত বা সহিংসতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তি যেন হোটেলে না উঠতে পারেন সেজন্য অধিকাংশ হোটেল কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার স্বার্থে নজরদারি বাড়িয়েছে। তারা বলছেন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে অতিথিদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে কক্ষ ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। ভাড়া নিতে আসা ব্যক্তি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি না, তা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

এখন পর্যটনের মৌসুম। আবার বছরের শেষভাগে নানা সামাজিক ও করপোরেট অনুষ্ঠানের সময়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটনের এই মৌসুমেও দেশের আবাসিক হোটেলগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অনেক কম
শুধু ঢাকা নয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় হোটেল ব্যবসায় মন্দা সময় চলছে দেশের প্রধানতম পর্যটন শহর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটেও। একই অবস্থায় কুয়াকাটায়ও। সেখানকার হোটেল কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাদের হোটেল ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

কুয়াকাটা গেস্ট হাউজের পরিচালক ও কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে বেশিরভাগ হোটেলের রুম এখন অতিথিশূন্য। দূরপাল্লার গণপরিবহন চলছে না। ফলে মানুষ এক জাগায় থেকে অন্য জায়গায় নিরাপদে যাতায়াত করতে পারছে না। এ কারণে হোটেলগুলোতেও পর্যটক/অতিথির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক হোটেলে বুকিং বাতিল করা হচ্ছে। হরতাল-অবরোধে পরিবার-পরিজন নিয়ে কেউই ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ করতে চায় না।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল।
হোটেল ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, রাজনৈতিক অঙ্গনের চলমান পরিস্থিতিতে হোটেল মালিকরা যেমন লোকসানে পড়বেন, পাশাপাশি এ খাতের কর্মচারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ব্যবসায় ধস নামায় অনেক হোটেল মালিক বাধ্য হয়ে কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে ঠিকমতো বেতন দিতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে খাত সংশ্লিষ্টদের চাওয়া, দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন দেশে স্থিতিশীলতা ফেরে। যেন জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়। অন্যথায় তাদের অনেকের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার উপক্রম হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *