সাত বছরের মধ্যে প্রথমবার আফ্রিকায় বেড়েছে চীনা ঋণ
প্রাকৃতিক সম্পদ, শিল্পায়ন, বাজার সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আফ্রিকায় এখনো অনেক খাত অনাবিষ্কৃত। এ কারণে সাম্প্রতিক বছরে মহাদেশটির প্রতি বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিগুলোর আগ্রহ বাড়ছে। অবশ্য তাদের আগে অঞ্চলটিতে বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবাহের দিক থেকে শীর্ষস্থান গ্রহণ করে নেয় চীন। পরবর্তী সময়ে কিছুটা পিছু হটলেও ২০২৩ সালে সাত বছরের মধ্যে প্রথমবার আফ্রিকায় ঋণ বাড়িয়েছে বেইজিং। এ সময় পরিবর্তন এসেছে ঋণ কৌশলে। খবর রয়টার্স।
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি সেন্টারের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, চীনা ঋণদাতারা ২০২৩ সালে আফ্রিকায় ৪৬১ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে, যা ২০১৬ সালের পর বার্ষিক হারে প্রথম বৃদ্ধি।
আফ্রিকায় ঋণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রেখে আসছিল চীনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। এর আওতায় ২০১২-১৮ সালের মধ্যে চীন থেকে বছরে ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে আফ্রিকার দেশগুলো। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে ঋণ দেয়ার পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে।
গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি সেন্টার সংকলিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গত বছর আফ্রিকায় চীনের ঋণ ২০২২ সালের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের মাধ্যমে অতি ঋণগ্রস্ত অর্থনীতিগুলোর ঝুঁকি কমাতে আগ্রহী চীন।
এ বিষয়ে গবেষকরা জানাচ্ছেন, ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে আরো টেকসই ভারসাম্যে পৌঁছতে চাইছে চীন। এখানে তারা নতুন একটি কৌশল নিয়ে পরীক্ষা করছে।
গবেষণা পরিসংখ্যানটি এমন সময় সামনে এল, যখন ফোরাম অন চীন-আফ্রিকা কো-অপারেশনের বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে পক্ষ দুটি। প্রতি তিন বছর পর এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
জরিপে দেখা গেছে, আটটি আফ্রিকান দেশ ও দুটি আফ্রিকান বহুপক্ষীয় ঋণদাতার সঙ্গে চীন গত বছর ১৩টি ঋণ চুক্তি করেছে। বড় চুক্তির মধ্যে রয়েছে কাদুনা-টু-কানো রেলওয়ে। এ প্রকল্পের জন্য নাইজেরিয়াকে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দিচ্ছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এছাড়া একই অংকের তারল্য সুবিধা দিচ্ছে মিসরের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আফ্রিকায় ৫৪টি দেশ রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাকি বিশ্ব থেকে পিছিয়ে। সাম্প্রতিক বছরে ইথিওপিয়ার মতো আফ্রিকার অনেক দেশে শীর্ষ দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা হিসেবে পৌঁছে গেছে চীন।
২০০০-২৩ সালের মধ্যে মহাদেশটিকে মোট ১৮ হাজার ২২৮ কোটি ডলার ঋণ বিতরণ করেছে এশিয়ার শীর্ষ এ অর্থনীতি। বেশির ভাগ অর্থই বিনিয়োগ হয়েছে আফ্রিকার জ্বালানি, পরিবহন ও আইসিটি খাতে।
চীনের বিআরএ প্রজেক্টের অনুপ্রেরণা হলো প্রাচীন সিল্ক রোড। যেখানে বিশ্বব্যাপী অবকাঠামোগত উন্নয়নে অবদান বাড়ানোর মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব প্রসারিত করতে চেয়েছে দেশটি। এ উদ্যোগের শুরুতে আফ্রিকায় একের পর এক নতুন প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে চীন।
কিন্তু ২০১৯ সাল নাগাদ মহাদেশটিতে বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ কমাতে শুরু করে চীন। এর মধ্যে পরের বছরের শুরুতে সারা বিশ্বে ছড়াতে থাকে কভিড-১৯ মহামারী। এ কারণে আফ্রিকায় চীনের ঋণপ্রবাহ কমার হার আরো দ্রুত হতে থাকে। ফলে অঞ্চলজুড়ে একগুচ্ছ প্রকল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এর একটি ছিল বড় আকারের আধুনিক রেল যোগাযোগ, যার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কেনিয়াকে যুক্ত করা হবে।
আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ কমার একাধিক কারণ রয়েছে। ওই সময় দেশটির অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। মন্থর প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক অস্থিতিশীলতা দেশটিকে নতুন কৌশল গ্রহণে বাধ্য করে। আবার অতিরিক্ত ঋণ চাপে নাজুক অবস্থায় পড়ে জাম্বিয়া, ঘানা ও ইথিওপিয়ার মতো দেশ। এসব দেশ থেকে অর্থ ফিরিয়ে আনাও চীনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে ২০২১ সাল নাগাদ ঋণ পুনর্গঠনের কৌশল গ্রহণ করে।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গত বছর বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে ঋণদাতা সংস্থাকে ২৫৯ কোটি ডলার সরবরাহ করেছে চীন, যা দেশটির মোট প্রতিশ্রুত ঋণের অর্ধেকেরও বেশি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, নতুন কৌশলের অংশ হিসেবে স্থানীয় ঋণদাতাদের আর্থিক সহায়তাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বেইজিং।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকি এড়ানোর কৌশল হিসেবে আফ্রিকান আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর মনোযোগ দিয়েছে চীনা ঋণদাতারা। এতে আফ্রিকান দেশগুলোর ঋণ চ্যালেঞ্জের সংস্পর্শ এড়ানো সহজ হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে হালনাগাদ প্রযুক্তি বেছে নিয়েছে চীন। ২০২৩ সালের প্রায় এক-দশমাংশ ঋণ পেয়েছে তিনটি সৌর ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এতে বোঝা যায়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তিতে অর্থায়নকে সুবিধাজনক ধরে নিয়েছে এশিয়ার দেশটি।
এর সঙ্গে গবেষকরা উল্লেখ করছেন, গত বছর চীনের দেয়া ঋণ পরিসংখ্যানে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। কারণ তারা দেখেছেন, স্থানীয় পর্যায়ে ঋণদাতাদের অর্থ সরবরাহের পাশাপাশি নাইজেরিয়া ও অ্যাঙ্গোলার মতো রুগ্ন অর্থনীতিকেও ঋণ দিয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন আফ্রিকায় চীনের অংশীদারত্ব গুণমান বজায় রাখবে কিনা তা দেখার বিষয় বলে জানিয়েছে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি সেন্টার।