সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আইসিডি হচ্ছে বিএম ডিপো

স্টাফ রিপোর্টার

মাস চারেক আগে আগুন ও বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত বিএম ডিপোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আইএমডিজি কোড বিশেষজ্ঞ। ডিপোর অভ্যন্তরে নির্মাণ করা হচ্ছে তিন লাখ গ্যালনের পানির ট্যাংক। ডেঞ্জারাস গুডস (ডিজি) কার্গোর জন্য নির্মিত হচ্ছে আলাদা শেড। কোনো কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে আগুন লাগার ১৯ মিনিটের মধ্যে কেমিক্যাল ফোমে ঢেকে যাবে পুরো ডিপো। এমন সব অত্যাধুনিক ব্যবস্থায় সাজছে হাজার কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বের নামি শিপিং কোম্পানি এইচঅ্যান্ডএম ও মার্সক লাইনের গ্লোবাল অফিসিয়ালরা ডিপোর কার্যক্রম পরিদর্শন করে নিরাপত্তার সার্বিক বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

জানা যায়, আগামীতে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস (আইএমডিজি) কোডের সব শর্ত মেনেই চলতে হবে দেশের সরকারি-বেসরকারি আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) ও অফডকগুলোকে। বর্তমানে অপারেশনে আছে ১৯টি আইসিডি। যার অধিকাংশই আইএমডিজি কোড মানার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এর মধ্যেও আগুন ও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বিএম কনটেইনার ডিপো হতে যাচ্ছে ব্যতিক্রম। আইএমডিজি কোড মানাসহ সেবা ও নিরাপত্তায় দেশসেরা আইসিডি হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে  বিএম ডিপোতে নতুন করে তৈরি হচ্ছে স্থাপনা। বিনিয়োগ করা হচ্ছে দেড়শ কোটি টাকা।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিএম ডিপোর প্রবেশপথে নিরাপত্তার কড়াকড়ি। ভেতরে চলছে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ। সিএফএসের স্টিলের স্ট্রাকচারগুলো সংযোজন করছেন প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা। সেখানে এখনো রয়েছে আগুনে পোড়া ছোপ ছোপ দাগ। নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে সিএফএস শেড, তৈরি হচ্ছে খাদ্যপণ্যের জন্য আলাদা শেড। তৈরি হচ্ছে তিনতলা প্রশাসনিক ভবন। ওই ভবনের নিচে তৈরি হচ্ছে তিন লাখ গ্যালন ধারণক্ষমতার রিজার্ভ পানির ট্যাংক। বসানো হচ্ছে তিনটি উচ্চ ক্ষমতার ফায়ার পাম্প। বসছে ৫৭টি হাইড্রেন্ট।

ডিপো কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রায় দুই লাখ ৮২ হাজার ঘনফুটের তিনটি সিএফএস (কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন) হচ্ছে। বিপজ্জনক পণ্যের জন্য থাকছে ১২ হাজার বর্গফুটের আলাদা শেড। যেখানে কেমিক্যাল বাদে জুটপণ্য রাখার সুযোগও রাখা হয়েছে।

দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ডিপোর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) নুরুল আকতার। বিস্ফোরণে তিনি তার বাম হাত হারিয়েছেন। বর্তমানে শারীরিকভাবে সুস্থ নুরুল আকতারের আরও উন্নত চিকিৎসার পদক্ষেপ নিয়েছে ডিপো কর্তৃপক্ষ। এখনো কয়েকজন ভারতে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন নুরুল আকতার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের আইসিডিগুলো ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস (আইএমডিজি) কোড মেনে চলার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ডিপোর মেনে চলার সুযোগ থাকে না। এরপরও দুর্ঘটনার আগে থেকে নিরাপত্তায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিল বিএম ডিপো। দুর্ঘটনাটি ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। দুর্ঘটনার প্রথম সপ্তাহেই নতুন নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আমাদের নতুন নির্বাহী পরিচালক একজন মাস্টার মেরিনার এবং আইএমডিজি এক্সপার্ট। তিনি এখন ডিপোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’

কথা হলে বিএম ডিপোর নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মাইনুল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএম ডিপো নতুন একটি ডিপো হিসেবে রূপ পাবে। নতুন লে আউটে ডিপোর স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। ভাঙা হচ্ছে আগের সব স্থাপনা। এখানে নতুন করে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে নিরাপত্তায়। শুধু অগ্নিদুর্ঘটনা নয়, সব ধরনের সিকিউরিটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে ডিপো কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিয়েছে। তার নির্দেশনায় সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘খোদ চট্টগ্রাম বন্দরেও ডিজি কার্গোর জন্য ডেডিকেটেড শেড নেই। কিন্তু এখন আমরা ডিজি কার্গোর জন্য প্রায় ১২ হাজার স্কয়ার ফুটের একটি শেড নির্মাণ করছি। খাদ্যপণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আলাদা শেড করা হচ্ছে। এই শেডটি অক্টোবরের মধ্যেই রেডি হয়ে যাবে। কাস্টম থেকে অনুমতি পেলে নভেম্বর থেকেই আমরা খাদ্যপণ্য হ্যান্ডলিং শুরু করবো।’

ডিপোতে কথা হয় সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার লে. কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা আমূল ঢেলে সাজানো হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা হচ্ছে আইএসডিএস সার্ভিল্যান্স সিস্টেম নামে একটি আধুনিক সফটওয়্যার। যেটি মূলত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে পুরো ডিপো মনিটরিং করবে। ডিপোর সীমানাপ্রাচীরেও লাইন ক্রসিং ডিটেকশন সিস্টেম যুক্ত করা হচ্ছে। কেউ সীমানার ওপর দিয়ে ডিপোতে প্রবেশ করতে কিংবা বের হতে চাইলে লেজার-রে’র মাধ্যমে ওই সিস্টেমে অ্যালার্ম বেজে উঠবে।’

জানা যায়, দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বিএম ডিপোর প্রায় ১২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হাতে-কলমে ফায়ার ফাইটিং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাছাড়া এখন থেকে বিএম ডিপোতে সার্বক্ষণিক একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংগ্রহ করা হয়েছে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের নতুন যন্ত্রপাতিও। ৪ জুন দুর্ঘটনার পর থেকে কোনো আয় না থাকলেও প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে ডিপো কর্তৃপক্ষ। দেওয়া হয়েছে ঈদ-পূজার বোনাসও। এ পর্যন্ত কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। উপরন্তু ডিপোতে কর্মরতদের জন্য বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধা।

নিরাপত্তা, টিমওয়ার্ক, মানোন্নয়ন এবং স্বচ্ছতাকে প্রাধান্য দিয়ে সেবার ভিত্তিতে বিএম ডিপো পরিচালনার প্রত্যয় জানিয়ে নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মাইনুল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি ভিশন নিয়ে কাজ করছি। এটি আকারে বড় না হলেও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নিরাপত্তা ও গ্রাহকসেবায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফাইনেস্ট ডিপো হবে। আমরা নিরাপত্তা, টিমওয়ার্ক, মানোন্নয়ন ও স্বচ্ছতাকে প্রাধান্য দেবো।

তিনি বলেন, ডিপোতে অত্যাধুনিক ফায়ার ডিটেকশন অ্যালার্ম সিস্টেম যুক্ত করা হচ্ছে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজে উঠবে। আমাদের যে ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম বসানো হচ্ছে, তাতে আগুন লাগার ১৯ মিনিটের মধ্যেই ২ লাখ ৮৬ হাজার স্কয়ার ফুটের পুরো শেড কেমিক্যাল ফোমে ঢেকে দেওয়া সম্ভব। তাছাড়া পানির যে রিজার্ভার নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে সবগুলো হাইড্রেন্ট একসঙ্গে চললেও একাধারে দুই ঘণ্টা পানি ছিটানো সম্ভব। বিএম ডিপোতে রিয়েল টাইম কনটেইনার এবং কার্গো ট্র্যাকিং সিস্টেম আনা হচ্ছে। এতে ডিপোতে আসা কনটেইনারগুলোর অবস্থান সম্পর্কে অনলাইনে ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে।

ক্যাপ্টেন মাইনুল বলেন, গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বখ্যাত শিপিং কোম্পানি এইচঅ্যান্ডএম এবং মার্কস লাইনের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্টসহ তাদের প্রতিনিধিরা ডিপো ভিজিট করে গেছেন। তারা ডিপোর সার্বিক নিরাপত্তা কার্যক্রম দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তারা চাইছেন দ্রুততম সময়ে ডিপো অপারেশনে যেতে। আশা করছি, আমরা প্রাথমিকভাবে নভেম্বর মাসের শুরু থেকে খাদ্যপণ্য হ্যান্ডলিং শুরু করতে পারবো। পাশাপাশি সবগুলো কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এতে জানুয়ারি থেকে পুরোদমে ডিপোতে অপারেশন শুরু করা যাবে। তবে অপারেশন শুরুর বিষয়টি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে ২৪ একর জায়গায় বিএম ডিপো গড়ে ওঠে। ২০১১ সালের মে মাসে ডিপোর অপারেশন শুরু হয়। সবশেষ ২০২১ সালে বিএম ডিপোতে ১ লাখ ২০ হাজার টিইইউ’স কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। এর মধ্যে এক্সপোর্ট কনটেইনার ছিল ৫৮ হাজার টিইইউ’স, ইম্পোর্ট কনটেইনার ২২ হাজার টিইইউ’স এবং খালি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪০ হাজার টিইইউ’স।

গত ৪ জুন অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বিএম ডিপোতে। এতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ মারা যান ৫১ জন। দুর্ঘটনায় প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ডিপো কর্তৃপক্ষের। এরই মধ্যে হতাহতদের প্রায় ১৮ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *