সংকুচিত থাকবে এলএনজির বৈশ্বিক বাজার
চলতি বছর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) বাজার সংকুচিত থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। গত বছরও সংকটের মধ্যে ছিল জ্বালানি পণ্যটির বাজার। ওই সময় এলএনজির চাহিদা ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যেকোনো সময় সর্বোচ্চে উঠে আসে দাম। সম্প্রতি বহুজাতিক ব্রিটিশ জ্বালানি তেল ও গ্যাস কোম্পানি শেলের বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত বছরের শুরু থেকেই করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্বের অর্থনীতিগুলোয় গতি ফিরতে শুরু করে। অনেক দেশেই শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা দেয়। এ সময় অনেক দেশই কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য বাস্তবায়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর কথা বললেও আদতে তা সম্ভব হয়নি। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল বিনিয়োগস্বল্পতা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার কম থাকায় লাফিয়ে বেড়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা। তুলনামূলক কম দূষণযোগ্য হওয়ায় এলএনজির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। কিন্তু সে তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ ছিল না। এ কারণে এলএনজির দাম অব্যাহতভাবে বাড়তে শুরু করে।
শেলের এনার্জি মার্কেটিং বিভাগের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিভ হিল বলেন, বর্তমানে আমরা এলএনজির বাজারদরে যে ঊর্ধ্বগতি দেখতে পাচ্ছি, তার প্রধান চালিকাশক্তি হিসবে কাজ করছে মজুদস্বল্পতা, সরবরাহ অনিশ্চয়তাসহ মৌলিক কিছু বিষয়।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে নতুন উৎস থেকে বাজারে সরবরাহ আসছে না। অন্যদিকে ঝুঁকি এড়াতে এলএনজি খাতে বিনিয়োগও কমিয়ে দিয়েছেন পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়গুলোও বাজারে চলমান সংকটের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এলএনজি ক্রেতা ও বিক্রেতা শেল। কোম্পানিটি সম্প্রতি জানায়, গত বছর বিশ্বজুড়ে এলএনজির বাণিজ্য ৬ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় সব মিলিয়ে ৩৮ কোটি টন এলএনজি আমদানি-রফতানি হয়েছে। মূলত করোনাভাইরাসের প্রভাব কিছুটা শিথিল হওয়ায় ব্যবহারকারী ও সরবরাহকারী দেশগুলোর অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার ঘটেছে। এ কারণেই জ্বালানি পণ্যটির বাণিজ্য সম্প্রসারণ হয়।
বার্ষিক এলএনজি মার্কেট আউটলুকে শেল জানায়, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে জ্বালানি পণ্যটির চাহিদা বর্তমানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বাড়বে। চাহিদার পরিমাণ দাঁড়াবে ৭০ কোটি টনে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহে যে বিপত্তি তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে প্রধান ভূমিকা পালন করবে এলএনজি।
প্রাকৃতিক গ্যাসের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রায় ৩০টি ব্রিটিশ জ্বালানি সরবরাহকারী কোম্পানি বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া বেশকিছু বড় কোম্পানি জ্বালানিনির্ভর খাতে উৎপাদন কমিয়ে এনেছে।
তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে কমতে শুরু করে জ্বালানির চাহিদা। কিন্তু ওই সময় বাজারে এলএনজিসহ অন্যান্য জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল। এ কারণে এলএনজির দাম রেকর্ড সর্বনিম্নে নেমে যায়। প্রতি এমএমবিটিইউর মূল্য স্থির হয় ২ ডলারে। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে পণ্যটির দাম এক লাফে রেকর্ড উচ্চতায় আরোহণ করে। প্রতি এমএমবিটিইউর মূল্য ৫৬ ডলারে উঠে আসে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ এলএনজির এমএমবিটিইউপ্রতি মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৫ ডলারে।
শেলের ইন্টিগ্রেটেড গ্যাস, রিনিউয়েবলস অ্যান্ড এনার্জি সলিউশন বিভাগের পরিচালক ওয়েল শন বলেন, বিশ্বজুড়ে জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যের বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলএনজি কতটা জরুরি তা গত বছর ভালোভাবেই টের পাওয়া গেছে। এ সময় গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে সব খাতেই।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০২০ সালের মাঝামাঝিতেই এলএনজির সরবরাহ ও চাহিদায় বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়। এ ব্যবধান বাড়ছে। বিশেষ করে বিশ্বের প্রধান এলএনজি আমদানিকারক অঞ্চল এশিয়ায় পণ্যটির চাহিদায় ঊল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। এটি বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধিতে জ্বালানি জোগাচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত এলএনজি পাচ্ছে না ব্যবহারকারী দেশগুলো। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এলএনজি খাতে বেশি বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন।
তথ্য বলছে, গত বছর চীনে এলএনজি আমদানি ১ কোটি ২০ লাখ টন বৃদ্ধি পায়। আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ কোটি ৯০ লাখ টনে। ২০২১ সালে দেশটির ক্রেতারা দুই কোটি টনেরও বেশি এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে।
শেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, তীব্র সংকট সত্ত্বেও গত বছর এলএনজির বৈশ্বিক রফতানি বেড়েছে। এতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছরও দেশটি লক্ষণীয় মাত্রায় এলএনজি রফতানিতে সক্ষম হবে।