শেয়ার কারসাজির তদন্তে ফের সাকিবের নাম: ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি

স্টাফ রিপোর্টার

শেয়ার কারসাজির তদন্ত করতে গিয়ে আবারও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নাম উঠে এসেছে। আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির তদন্ত করে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে সাকিবের নাম রয়েছে। তবে সাকিবের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি।

এর আগে আরও চারটি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির তদন্তে সাকিবের নাম উঠে আসে। কারসাজির তদন্ত প্রতিবেদনে সাকিবের নাম থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি। বারবার একই কারসাজি চক্রের সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদনে সাকিবের নামও উঠে আসছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চক্রের মূলহোতা আবুল খায়ের। শেয়ারবাজারে যিনি হিরু নামে পরিচিত। শেয়ার কারসাজির যে কয়টি তদন্ত প্রতিবেদনে সাকিবের নাম জড়িয়েছে, তার প্রতিটিতেই রয়েছে আবুল খায়ের হিরু এবং হিরুর বাবা, বোন ও স্ত্রীর নাম।

সর্বশেষ আইপিডিসি ফাইন্যান্সের কারসাজি নিয়ে বিএসইসির করা তদন্তে সাকিবের নাম উঠে এসেছে। কারসাজির মাধ্যমে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম বাড়ানোর অপরাধে আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আবুল খায়ের ও তার সহযোগীরা সিরিজ লেনদেনের মাধ্যমে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার দাম বাড়িয়েছেন। এতে চলতি বছরের ২৯ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিলের মধ্যে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার দাম বেড়েছে ৬০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এ সময়ে ৩৪ টাকা থেকে বেড়ে কোম্পানিটির শেয়ার দাম ৫৪ টাকা ৭০ পয়সায় ওঠে।

হিরু ও তার সহযোগীরা এ সময়ের মধ্যে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার বিক্রি করে ৬ কোটি ৬১ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ টাকা মুনাফা করেছেন। এছাড়া তাদের কাছে থাকা শেয়ারে আরও ১২ কোটি ৯৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩৬ টাকা মুনাফা রয়েছে।

নিজেদের মধ্যে লেনদেন করে কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ানোকে স্টক এক্সচেঞ্জের ভাষায় ‘সিরিয়াল ট্রেডিং’ বা ‘সিরিজ লেনদেন’ বলা হয়। এভাবে শেয়ারের মূল্য প্রভাবিত করা আইনত নিষিদ্ধ।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শেয়ার বিক্রির তালিকায় রয়েছেন সাকিব। এই ক্রিকেটার ইবিএল সিকিউরিটিজে থাকা তার বিও হিসাবের মাধ্যমে ১২ কোটি ২ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭৪ টাকার শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করেছেন। এর মধ্যে ১১ লাখ শেয়ার কিনে সাকিব ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৩৩টি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।

অন্যদিকে এ সময়ে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ারের সর্বোচ্চ ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই আবুল খায়ের হিরু। হিরু ১ কোটি ৩৭ লাখ ৭১ হাজার ২৯২টি শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছেন ১ কোটি ৪ লাখ ৬১ হাজার ১৮৪টি। তার লেনদেনের পরিমাণ ১২ কোটি ২ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭৪ টাকা।

আইন লঙ্ঘন করে শেয়ার লেনদেন করার প্রমাণ পাওয়ায় বিএসইসি আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের জরিমানা করেছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এদিকে সম্প্রতি ফরচুন সুজ, বিডিকম অনলাইন, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির বিষয়ে করা তদন্তেও সাকিব আল হাসানের নাম জড়ায়।

বিএসইসি’র তদন্তে গত ২ বছরে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির জন্য মোনার্ক হোল্ডিংসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়। মোনার্ক হোল্ডিংস ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ব্রোকারেজ হাউজ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাকিব আল হাসান। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল খায়ের হিরুর স্ত্রী সাদিয়া হাসান।

বিএসইসি’র তদন্তে উঠে আসে, আবুল খায়ের গত বছরের ২০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত তার সহযোগীদের মধ্যে শেয়ার বেচাকেনা করে ফরচুন সুজের শেয়ারের মূল্যকে প্রভাবিত করেন। এতে ২০ দিনে ফরচুনের শেয়ারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়। ওই সময় ফরচুনের শেয়ারের শীর্ষ ক্রেতাদের মধ্যে সাকিবের নাম ছিল। তিনি তার বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩৫ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার কিনেছিলেন এবং একই সময়ে বিক্রি করেছিলেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার শেয়ার।

এছাড়া গত বছরের ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর আবুল খায়ের ও তার সহযোগীরা সিরিজ লেনদেন করে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার দাম প্রভাবিত করেন। সে সময় সাকিব ওয়ান ব্যাংকের ৭৫ লাখ শেয়ার কেনেন এবং ১০ লাখ ২০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেন। ওই ১৫ দিনে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম বাড়ে ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ।

বিএসইসি’র আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৫ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১৭২ শতাংশ বেড়েছিল। সাকিব ওই ব্যাংকের ২৭ লাখ শেয়ার কেনেন এবং ১ লাখ শেয়ার বিক্রি করেন। ডিআইটি কো-অপারেটিভ এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য কারসাজিতে ভূমিকা রেখেছিল। আবুল খায়ের ডিআইটি কো-অপারেটিভের চেয়ারম্যান।

এছাড়া বিডিকম অনলাইনের শেয়ারের মূল্য কারসাজিতে সাকিবের মোনার্ক হোল্ডিংসের নাম জড়ায়। বিএসইসি’র তদন্তে উঠে আসে, চলতি বছরের মার্চে মাত্র চারদিনে বিডিকম অনলাইনের শেয়ারের দাম ৪৫ শতাংশ বাড়ে। এ কোম্পানির ২৫ লাখ শেয়ার কেনে সাকিবের মোনার্ক হোল্ডিংস, যা শীর্ষ ক্রেতার তালিকায় পঞ্চম।

মোনার্ক হোল্ডিংস ওই ৪ দিনে ৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ‘আনরিয়েলাইজড গেইন’ করে। কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ার পরও শেয়ারহোল্ডার যখন তা বিক্রি না করে রেখে দেয়, তখন ওই শেয়ারের বাড়তি দামকে ‘আনরিয়েলাইজড গেইন’ বলে। অর্থাৎ একজন ১০ টাকা দিয়ে কোনো শেয়ার কেনার পর তার দাম ১৩ টাকা হওয়ার পরও যদি তিনি তা বিক্রি না করেন তাহলে আনরিয়েলাইজড গেইন হবে ৩ টাকা।

এভাবে বারবার শেয়ার কারসাজির তদন্তে সাকিবের নাম আসলেও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রিজাউল করিম বলেন, যখন কোনো সিকিউরিটিজ নিয়ে তদন্ত করা হয়, তখন বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে তদন্ত দল। সেখানে বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যাদের নাম থাকে সবাই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত না। সাকিবের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যে কারণে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *