শেয়ারবাজার ছন্নছাড়া, দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রায় প্রতিদিনই দেশের শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে। শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার মাধ্যমে প্রতিদিনেই বিনিয়োগ করা অর্থ হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে কাউকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে দিন যত যাচ্ছে লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে এবং দিশেহারা হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাজারের এ অবস্থাকে নীরব রক্তক্ষরণের সঙ্গে তুলনা করছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা বলছেন, প্রতিদিনই বাজার ভালো হবে এমন আশায় থাকেন। কিন্তু বাস্তবে প্রায় প্রতিদিন শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে। মাঝে মধ্যে একটু ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিলেও পরক্ষণেই পতন হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ করা পুঁজি রক্ষার কোনো উপায় পাচ্ছেন না তারা।

এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যদি বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ে তাহলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। আর এখন বাজারে যে দরপতন হচ্ছে, এ দরপতনের পেছনে কোনো অস্বাভাবিক কারণ থাকলে তা খুঁজে বের করা হবে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ বর্তমানে বিনিয়োগ না করে বাজার পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তাছাড়া সম্প্রতি যে হারে বাজার পড়েছে, তাতে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী লোকসানে রয়েছেন। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা লোকসানে শেয়ার বিক্রির করবেন না। তাই আশা করা যায় শিগগির বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।

আগের কার্যদিবসের ধারাবাহিকতায় সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবস বুধবারও (২৪ এপ্রিল ২০২৪) দেশের শেয়ারবাজারে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। ফলে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। এর মাধ্যমে ঈদের পর লেনদেন হওয়া আট কার্যদিবসের মধ্যে ৭ কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হলো।

এর আগে ঈদের পর টানা পাঁচ কার্যদিবস দরপতনের পর গত সোমবার শেয়ারবাজারে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখিতার দেখা মিলে। কিন্তু পরের কার্যদিবস মঙ্গলবার শেয়ারবাজারে ফের দরপতন হয়। বুধবারও বড় পতন দেখতে হলো বিনিয়োগকারীদের। এতে আগে থেকেই লোকসানের মধ্যে থাকা বিনিয়োগকারীদের লোকসান আরও বেড়েছে।

বাজারের এ চিত্র সম্পর্কে বিনিয়োগকারী হায়দার বলেন, প্রতিদিন আশায় থাকি বাজার ভালো হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বাজার ভালো হচ্ছে না। প্রতিদিনই লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। আর বিনিয়োগ করা পুঁজির পরিমাণ কমছে। বাজারের চিন্তায় রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারছি না। মনে হচ্ছে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আগে শেয়ারবাজারে দরপতন হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, ডিএসই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতো। কিন্তু এখন কাউকে কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। শেয়ারবাজার যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষার করার জন্য যেন কেউ নেই।

তিনি আরও বলেন, আমি বিনিয়োগ করা প্রতিটি শেয়ারের লোকসানে রয়েছি। ৮০ টাকা দিয়ে কেনা ফরচুন সুজের দাম কমে ৩৭ টাকায় চলে এসেছে। ২৬ টাকা করে কেনা বে-লিজিং ১১ টাকায় নেমেছে। এভাবে সবগুলো শেয়ারের বড় লোকসানে রয়েছি। এ লোকসান থেকে হয় তো কোনোদিনই বের হতে পারবো না। আমার মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, ব্যাংকের সুদের হার বেড়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাজার যে হারে পড়েছে, তা মোটেও স্বাভাবিক না। অস্বাভাবিক দরপতনের ফলে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীরা এখন লোকসানের মধ্যে রয়েছেন। বিনিয়োগকারীরা এতটাই লোকসানে রয়েছেন তারা তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। এ দরপতনের পেছনে কোনো চক্রের হাত রয়েছে কি না তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষতিয়ে দেখা উচিত।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, বাজার এখন যে জায়গায় আছে, এ জায়গা থেকে কেউ লাভ করে বিক্রি করতে পারছে না। এখান থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে, এটা সময়ের ব্যাপার। যথেষ্ট কারেকশন হয়েছে।

শেয়ারবাজারে এতটা মূল্য সংশোধন হওয়ার কারণ কি? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়া এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণ তো আছে। তাছাড়া একজন বিনিয়োগকারী কখন বিনিয়োগ করবে, কখন করবেন না এটা তার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার।

যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কমিশন সবসময় চাই বাজার ইতিবাচক ধারায় থাকুক। বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ছে বাজার ইতিবাচক ধারা ফিরবে বলে আমরা আশা করছি।

সাম্প্রতিক সময়ের দরপতনকে স্বাভাবিক মনে করছেন কি? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে যে দরপতন হয়েছে, সে বিষয়ে কমিশনের সার্ভিলেন্স নিয়মিত মনিটরিং করছে। কোনো ধরনের অস্বাভাবিক কিছু পেলে কমিশন অবশ্যই পদক্ষেপ নেবো। যদি কেউ বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে কমিশন দ্রুত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

বুধবার দিন  শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে ৭৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে দাম কমেছে ২৭৪টি প্রতিষ্ঠানের। আর ৪১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৫৪ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৫৭৮ পয়েন্টে নেমে গেছে।

অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৬ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২২৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। তবে বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৪ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৯৮৪ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

প্রধান মূল্যসূচক কমলেও ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৬০২ কোটি ৭৪ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৫৯৭ কোটি ৫৬ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন বেড়েছে ৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

এই লেনদেনে সব থেকে বেশি অবদান রেখেছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিসের শেয়ার। কোম্পানিটির ৩৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ওরিয়ন ইনফিউশনের ২৩ কোটি ৪২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ২২ কোটি ৭২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে লাভেলো আইসক্রিম।

এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- মালেক স্পিনিং, গোল্ডেন সন, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, কহিনুর কেমিক্যালস, আফতাব অটোমোবাইলস, বেস্ট হোল্ডিং এবং আইটি কনসালটেন্ট।

অপর শেয়ারবাজার সিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৭৩ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ২২৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪১টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৬৬টির এবং ২০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ২৬ কোটি ৭ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ১৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *