শিশুর ব্রণের সমস্যা দূর করার ম্যাজিক টিপস

ব্রণ শুধু বয়ঃসন্ধিকালেই হয়, অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের মুখে কিংবা শরীরের অন্যান্য স্থানে ব্রণ হয়—এমন ধারণা অনেকেই করেন। ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। বয়ঃসন্ধিকালের বয়সেই কেবল নয়, শিশুদের ক্ষেত্রেও ব্রণ ওঠাটা বিরল নয়।

যদিও ২০ বছর বয়সে ব্রণের বিস্তার বেশি হয়, কিন্তু ত্বকের এই অবস্থার ব্যাপারে তখন তারা নিজেরাই সচেতন থাকে। এটি শিশুদের পক্ষে কোনো দিন সম্ভব হবে না। তাই শিশুদের ব্রণের ব্যাপারে বাবা-মাকেই সচেতন হতে হবে। শিশুর মুখে কিংবা শরীরের অন্য ত্বকে সামান্য ব্রণ দেখা দিলেই কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন কিছু নেই যা প্রথমবারের মতো ব্রণ ওঠাকে রোধ করতে পারে। তবে ব্রণ নিয়ন্ত্রণ করতে আপনি অনেক কিছুই করতে পারেন। সৌভাগ্যক্রমে বেনজয়েল পারঅক্সাইড এমন এক উপকরণ, যেটি অনেক ব্রণবিরোধী ওষুধে থাকে এবং এটা বেশ কার্যকর। ব্রণ প্রতিরোধে যা করবেন :

কার্যকর ওষুধটি কিনুন
যেকোনো ওষুধের দোকানে গিয়ে বেনজয়েল পারঅক্সাইডসমৃদ্ধ লোশন কিংবা জেল-এর খোঁজ করুন। জেল সবচেয়ে বেশি কার্যকর। যেখানে প্রয়োজন কেবল সেই স্তরটার সামান্য নিচে প্রয়োগ করুন। বাজারে বেনজয়েল পার অক্সাইডসমৃদ্ধ সাবানও পাওয়া যায়, কিন্তু ওগুলো জেল কিংবা লোশনের মতো ততটা কার্যকরী নয়। তবে যেকোনো ওষুধ গ্রহণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আপনার শিশুকে ওষুধটি প্রয়োগ করার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন এই ওষুধের প্রতি তার অ্যালার্জি আছে কি না। অ্যালার্জির ব্যাপারে নিশ্চিত হতে প্রথমে সামান্য পরিমাণ জেল নিন, তারপর সেটা আপনার শিশুর হাতের উল্টো পাশে ঘষুন। এরপর একদিন অপেক্ষা করে দেখুন জায়গাটা লাল হয় কি না অথবা সেখানে চুলকানি বা জ্বালাপোড়া করে কি না। যদি সে রকম কিছু হয় তাহলে অন্য ওষুধের জন্য আপনার শিশুর চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজন হবে।

আপনার শিশুকে ওষুধ প্রয়োগ শুরু করলে তার পুরো মুখমণ্ডলে সেটা মাখবেন। ব্রণ যদি তার বুকে এবং পিঠে হয় তাহলে সেসব স্থানেও মাখতে হবে। বেনজয়েল পারঅক্সাইড কেবলমাত্র গজিয়ে ওঠা ফুসকুড়িকেই সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে না, এটা নতুন ফুসকুড়ি উৎপন্নেও বাধা দেয়।

সুতরাং আপনার শিশুর ত্বকের ব্রণমুক্ত স্থানেও ওষুধ মাখবেন। সাধারণত দিনে একবার মাখলেই যথেষ্ট, তবে ব্রণ খুব বেশি হলে দিনে দুবার মাখা যেতে পারে।

ঘুমাতে যাওয়ার সময়ের জন্য অপেক্ষা করুন
বেনজয়েল ওষুধের দুর্ভাগ্যজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো এটা পোশাকের সংস্পর্শে এলে সেখানে দাগ সৃষ্টি করে। তাই এ ধরনের ক্ষতি এড়াতে আপনার শিশুর ত্বকে অল্প করে ওষুধটি মাখিয়ে দেবেন এবং হালকা করে ঘষে দেবেন। ওষুধ মাখার সময় তা যেন তোয়ালে, চাদরে কিংবা কার্পেটে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখবেন। শিশুর স্কুলের পোশাক যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো শিশু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ওষুধ ব্যবহার করা। যদি ওষুধটি সকালে ব্যবহার করেন তাহলে ভালো হয়। পোশাক পরার পরে হালকা করে তা মাখলে কিংবা পোশাক পরার আগে ওষুধটি মেখে তা শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে।

স্বল্পমাত্রা দিয়ে শুরু করুন
বেনজয়েল পারঅক্সাইড দ্রবণ বিভিন্ন মাত্রায় পাওয়া যায়, যেমন : ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ৫ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ। স্বল্পমাত্রারটি ত্বকে কম অস্বস্তি ঘটায়। সুতরাং আপনার শিশুর ব্রণের চিকিৎসায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ দিয়ে শুরু করুন। যদি এই স্বল্পমাত্রায় কাজ না হয়, তখন শক্তিশালী মাত্রা প্রয়োগ করতে পারেন।

ধৈর্য ধরুন
তাপমাত্রার শিশুর চেহারার সত্যিকারের উন্নতির জন্য ব্রণের ওষুধগুলো ছয় থেকে আট সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি সময় ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। তাই ধৈর্য না হারিয়ে ওষুধ ব্যবহার করতে থাকুন। আর যদি বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটে এবং আপনার শিশুর ত্বকের অবস্থা খারাপ হতে থাকে তাহলে ওষুধটি বন্ধ করে দিন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

ফুসকুড়ির ওপর চাপ দেবেন না
ফুসকুড়ি বা ব্রণের ওপর চাপ দিয়ে কিংবা খোঁটাখুঁটি করলে তা আরো ছড়িয়ে পড়ে। তাই আপনার শিশুকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেবেন সে যেন ব্রণে চাপ না দেয়। অন্য কোনোভাবেও যেন ব্রণে চাপ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ক্লাসরুমে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকানোর সময় চিবুকে হাত রাখলেও ব্রণ বেড়ে যেতে পারে।

ফাস্টফুড পরিহার করুন
যদিও বার্গার, ফ্রাই করা খাবার এবং চকলেট নিজেরা ব্রণ উৎপন্ন করে না। কিন্তু এসব খাবারে উচ্চমাত্রার আয়োডিন থাকায় ব্রণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। উচ্চমাত্রার আয়োডিন ব্রণের বিস্তার ঘটায়। আপনার শিশুর যদি ফাস্টফুডের প্রতি বেশি ঝোঁক থাকে তাহলে তাকে বার্গার কম খাওয়ার পরামর্শ দিন এবং সালাদ খেতে দিন বেশি করে।

নিরাপদ প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহার করুন
আপনার শিশুর ত্বকের যত্নে যে সাবান, সানস্ক্রিন, ময়েশ্চারাইজার বা প্রসাধন কিনুন না কেন, আপনি নিশ্চিত হয়ে নিন এসব সামগ্রী আপনার শিশুর ত্বকে অস্বস্তি ঘটায় কি না অথবা ব্রণ বাড়িয়ে দেয় কি না। কিছু সামগ্রী রয়েছে যেগুলো নন-একনিজনিক। এটার অর্থ হলো এসব সামগ্রী ব্রণের বিস্তার ঘটায় না।

ভালো প্রসাধন সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ডোভ কিংবা নিউট্রোজেনা সাবান, প্রিসান, ফটোপ্লেক্স অথবা নিউট্রোজেনা সানব্লক সানস্ক্রিন এবং পারপাজ, নিউট্রোজেনা ময়েশ্চার অথবা ময়েশ্চারেল ময়েশ্চারাইজার প্রভৃতি। যেকোনো ব্র্যান্ডের প্রসাধনকেই ভালো বলা যাবে যদি তা ত্বকে কোনো ধরনের অস্বস্তি না ঘটায়। যদি কোনো প্রসাধন সন্দেহজনক মনে হয় তাহলে ত্বক বিশেষজ্ঞকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিন।

জোরে ঘষাঘষি করবেন না
ব্রণ টিপবেন না কিংবা ঘষাঘষি করবেন না। অনেকে মনে করে, ভালো করে ঘষলে বোধহয় উপকার হয়। কিন্তু মনে রাখবেন, পরিচ্ছন্নতার অভাবের জন্য ব্রণ হয় না। তাই জোরে ঘষামাজা করবেন না। শিশুর মুখ পরিষ্কারের সময় আস্তে আস্তে পরিষ্কার করবেন। ব্রণের ওপর জোরে চাপ পড়লে অবস্থার অবনতি হয়।

চুলে পমেড ব্যবহার করবেন না
আপনার শিশুর চুল যদি রুক্ষ হয়, তাহলে সামান্য প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার করলে ক্ষতি নেই। বাইরের এই তেল থেকে ব্রণ হয় না। ত্বকের নিচের তেল ব্রণ ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু আপনার শিশুর রুক্ষ চুল ঝলমলে করার জন্য পিচ্ছিল পমেড যেমন ড্যাক্স পমেড বা আল্ট্রাশাইন ব্যবহার করবেন না। চুলে এসব পমেড ব্যবহার করলে তা মুখমণ্ডলে গড়িয়ে নামতে পারে। এসব পণ্যে থাকে কৃত্রিম তেল, যেমন পেট্রোলিয়াম জেলি যা ত্বকের তেলগ্রন্থিকে বন্ধ করে দিতে পারে এবং ব্রণ ঘটাতে পারে।

মানসিক চাপের মাত্রা কমিয়ে আনুন
হ্যাঁ, বর্তমানে টিনএজ-পূর্ব ছেলেমেয়েদের মধ্যে মানসিক চাপ লক্ষ করা যায়। আর নিঃসন্দেহে মানসিক চাপ ব্রণের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। মানসিক চাপ টেসটোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে তেলগ্রন্থির সক্রিয়তাও বেড়ে যায়। সুতরাং আপনার শিশুর মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখুন। শিশুকে সর্বদা প্রফুল্ল ও আনন্দপূর্ণ মেজাজে রাখুন।

কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
কুৎসিত ব্রণে ভোগা শিশুর জন্য এক যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা। তবে বর্তমানে প্রচুর ওষুধ ও চিকিৎসাপদ্ধতি বেরিয়েছে, যার সাহায্যে তীব ব্রণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যদি ঘরোয়া চিকিৎসার দুই অথবা তিন মাস পরে আপনার শিশুর ত্বকের উন্নতি না হয়, তাহলে ত্বক বিশেষজ্ঞকে দেখাতে হবে।

ত্বক বিশেষজ্ঞ শক্তিশালী ওষুধ যেমন অধিক কার্যকর বেনজয়েল পারঅক্সাইড জেল, ভিটামিন ‘এ’ থেকে উৎপন্ন পদার্থ যেমন রেটিন-এ এবং বিভিন্ন স্থানিক বা অভ্যন্তরীণ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন। এসব উপকরণ আপনার শিশুর চেহারাকে সুন্দর করে তুলবে এবং তার শৈশবকে করে তুলবে সুখময় ও চাপমুক্ত।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *