শিশুর আঙুল চোষা

আঙুল চোষা প্রায় সব শিশুর ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ অভ্যাস। শিশু আঙুল চুষলে বাবা-মা অনেক সময় চিন্তিত হয়ে পড়েন, ভাবেন- বুঝি অভ্যাসটা তার চিরজীবন থেকেই যায়। অনেক শিশু অনেক বড় হয়েও আঙুল চোষে।

বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একমত যে, কখনো কখনো আঙুল চোষা শিশুর জন্য আদৌ সমস্যার ব্যাপার নয়। ডেনভারের ক্লিনিকল সাইকোলজিস্ট সুসান হেইটলার বলেন, এটা নিরাপত্তাহীনতা বা সংশয়াপন্নের চিহ্ন নয়- এটা শিশুর সাধারণ একটা অভ্যাস। যদি শিশু বিক্ষুব্ধ বা উত্তেজিত হয় তাহলে এটা তাকে শান্ত করে। আর যদি সে একঘেয়েমিজনিত ক্লান্ত হয়, তাহলে এটা তাকে উদ্দীপ্ত করে।

শিশুর বয়স যদি পাঁচ বছরের কম হয়, তাহলে ভালো উপায় হলো এটাকে উপেক্ষা করা। শিশু যদি শুধু মাঝেমধ্যে আঙুল চোষে এবং এটা তার দাঁত বা আঙুলের জন্য ক্ষতিকর না হয়, তাহলে কিছুই করার দরকার নেই। এ তথ্যটি জানাচ্ছেন পেডিয়াট্রিক ডেনটিস্ট্রির অধ্যাপক ডা. স্টিফেন জোয়েপফ্রেড।

শিশু যদি পাঁচ বছরের পরও প্রবলভাবে আঙুল চুষতে থাকে তাহলে সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুর দাঁত উঁচু হওয়ার ঝুঁকি থাকে, ক্রমাগত আঙুল চোষার ফলে আঙুলের গঠনে অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে এবং নখের নিচে ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে।

স্কুল বা প্রিস্কুল শিশুরা ঘন ঘন আঙুল চুষলে সামাজিক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে পারে। স্কুলে শিশু যদি আঙুল চুষতে থাকে, তাহলে তার সহপাঠীরা এটা নিয়ে মজা ও ঠাট্টা করবে। তাই আপনার স্কুলে কাছাকাছি বয়সী ছেলেমেয়ের যদি এখনো আঙুল চোষার অভ্যাস থাকে, তাহলে আপনি কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেন।

ক্রমাগত খুঁত ধরবেন না

আপনার শিশুর বয়স যা-ই হোক না কেন, তার অভ্যাসের ব্যাপারে তাকে তিরস্কার করবেন না। যদি আপনার শিশুকে তার আঙ্গুল চোষা নিয়ে তিরস্কার করে থাকেন, তাহলে এখনই সেটা বন্ধ করুন। শিশুর মুখ থেকে আঙুল টেনে বের করার চেষ্টা করবেন না। একসময় শিশু নিজ থেকেই আঙুল চোষা বন্ধ করে দেবে।

শিশুর সংকেত বোঝার চেষ্টা করুন

আপনি যদি আপনার শিশুকে আঙুল চোষা থেকে শান্তভাবে বিরত রাখতে চান তাহলে কখন কেন সে আঙুল চুষছে সে ব্যাপারটা লক্ষ করুন। যদি আপনার শিশু আপনা আপনি আঙুল চুষতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে সে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত কিংবা বিরক্ত হয়ে পড়েছে আর তাই সে নিজের আঙুল চুষে স্বস্তি ও আরাম পেতে চাইছে। যদি সে ক্লান্ত বা বিরক্ত বোধ করে, তাহলে আপনি তার হাতে খেলনা সামগ্রী অথবা বই তুলে দিন।

শিশুর মনোযোগ অন্য দিকে দিন

কখনো কখনো আঙুল চোষা ও কম্বল বা খেলনা ভালুক আঁকড়ে ধরে থাকার অভ্যাসটা একই সূত্রে গাঁথা। শিশুর শোয়ার ঘরে এগুলো রাখুন, তাহলে তার হাত ও আঙুল সবই ব্যস্ত থাকবে ওগুলো নিয়ে, ফলে সে ধীরে ধীরে আঙুল চোষার কথা ভুলে যাবে।

সময়ের হাতে ছেড়ে দিন

যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে, সময় হলে আপনার শিশু ঠিকই আঙুল চোষার অভ্যাস ত্যাগ করবে, তাহলে অযথা তাকে আঙুল চোষা ত্যাগ করতে বাধ্য করবেন না। সাধারণভাবে একজন শিশু তিন মাস বয়স থেকে আঙুল চোষা শুরু করে এবং এ অভ্যাসটা প্রায় তিন, চার অথবা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত থাকে।

শিশুকে কারণ দেখান

যদি আপনার শিশু কিন্ডারগার্টেনে যেতে শুরু করে এবং দেখেন যে তার আঙুল চোষা নিয়ে সহপাঠীরা মজা করছে, তখন আপনি স্বভাবতই চাইবেন যে আপনার শিশু আঙুল চোষা বন্ধ করুক। এ ক্ষেত্রে আপনি আপনার শিশুকে অন্য শিশুদের দেখাতে পারেন যারা আঙুল চোষে না। আপনি তাকে বলতে পারেন, আঙুলের চাপে তার দাঁতের ক্ষতি হবে। আপনার শিশুর চিকিৎসকও এটা তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। শিশুর আঙুল চোষা ছাড়াতে এটা তাকে বোঝানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তারিখ বেঁধে দিন

কখনো কখনো আপনি আপনার শিশুকে একটা নির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে দিতে পারেন যে, এই তারিখ থেকে সে আর আঙুল চুষবে না। কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার শুরুতে তারিখটা বেঁধে দিলে ভালো হয়। এটা তার জীবনে একটা বিশেষ ঘটনা হয়ে থাকবে। আপনি তার আঙুল চোষা বন্ধ করার একটা তারিখ পছন্দ করুন, তারপর শিশুর সঙ্গে বসে এটা রঙিন ছক তৈরি করুন যেখানে থাকবে কোনো সময় বা দিনগুলোতে সে আঙুল না চুষেই থাকতে পারছে। এতে আপনার শিশুর মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুভূতি জন্ম নেবে। ছক দেখে সে তার উন্নতি বুঝতে পারবে।

সাফল্যের জন্য পুরস্কার দিন

আপনার ছকের ব্যবস্থার সঙ্গে শিশুকে ছোটখাটো পুরস্কার দেওয়ারও ব্যবস্থা রাখুন। এতে সে পুরস্কার পাওয়ার আশায় আঙুল চোষার অভ্যাস ত্যাগ করতে চেষ্টা করবে।

যদি আপনার শিশু আঙুল চোষাবিহীন একটা দিন কাটাতে পারে, তাহলে তাকে একটা স্টার দিন। তাকে বলুন, আঙুল না চুষে এভাবে কতটা স্টার সে জমাতে পারে। স্টারের বদলে নতুন নতুন খেলনাও দিতে পারেন। এভাবে সে আঙুল চোষার অভ্যাস ছেড়ে দেবে।

শিশুকে আঁকা শেখান

মনোগ্রামযুক্ত ডট্ টু ডট্ গেম শুধু শিশুকে উৎসাহ জোগায় না, তার মধ্যে আত্মসংযমের অনুভূতি তৈরি করে। একটা ম্যাগাজিনের ছবি বের করে সেটার মতো শিশুকে আঁকতে বলুন। ছবির ওপরে একটা সাদা কাগজে বিছিয়ে ছবির বাইরের দাগ বরাবর বিন্দু টানতে বলুন। এটা শিশুর জন্য একটা সৃষ্টিশীল কাজ। যে সময়টাতে আঙুল চুষত সে সময়টা তার আঁকার মাধ্যমেই কেটে যাবে।

কৌশলে সতর্ক করুন

আপনার শিশু চেষ্টা করেও আঙুল চোষা ছাড়তে পারছে না। অনেক সময় সে বেখেয়ালে আঙুল মুখে পুরে বসে থাকে। এটা তার কখনো মনে থাকে না যে সে আঙুল মুখের মধ্যে রেখে দিয়েছে। এ ব্যাপারে তাকে সচেতন করতে হবে। আপনার শিশুর বুড়ো আঙুলে ছোট অ্যাডেসিভ টেপ পেঁচিয়ে লাগিয়ে রাখতে পারেন যাতে সে আঙুলটা মুখে পুরলেই এ ব্যাপারে সচেতন হয়। যদি এতেও কাজ না হয় তাহলে এই ব্যান্ডেজের ওপর সামান্য ভিনেগার লাগিয়ে রাখবেন। ভিনেগারের স্বাদ তাকে মনে করিয়ে দেবে, আঙুল চোষা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

স্বাস্থ্যগত ব্যবস্থা নিন

যদি আপনার শিশু ঘুমের মধ্যে আঙুল চোষে, এমনকি আঙুলে ব্যান্ডেজ নিয়েও চুষতে থাকে, তাহলে ঘুমের সময় তার হাতে গ্লাভস বা হাত মোজা পরিয়ে রাখুন।

বুড়ো আঙুলে ওষুধ লাগান

শিশুর আঙুল চোষা বন্ধ করতে তার হাতের বুড়ো আঙুলে তেতো ওষুধ লাগিয়ে রাখতে পারেন। বর্তমানে শিশুর জন্য নিরাপদ এমন ওষুধ পাওয়া যায়। এগুলোতে তেতো উপাদান থাকে এবং তা শিশুর স্বাদ নিরূপক কোষগ্রন্থিতে আঘাত করে। ফলে আঙুল মুখে নিলেই শিশু তেতো স্বাদ পায় ও পরে আর আঙুল মুখে নেয় না।

তবে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে শিশু এটাকে শাস্তি ভাবছে না। শিশুকে বলুন এখানে কিছু ওষুধ আছে যা সে ভুলে আঙুল মুখে পুরলে তাকে সতর্ক করে দেবে।

মনে রাখতে হবে আঙুল চোষা কোনো অসুখ নয়। এটা শিশুদের এক ধরনের আরামদায়ক অভ্যাস। তাই এ নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা না করাই ভালো। শিশু আঙুল চুষলে জোর করে ছাড়ানোর চেষ্টা করবেন না কিংবা বিকল্প হিসেবে কোনো চুষি কাঠি শিশুকে দেবেন না, তাতে ক্ষতি হতে পারে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *