শিশুদের প্রস্রাবের জটিলতা

স্টাফ রিপোর্টার

বিভিন্ন কারণে শিশুদের প্রস্রাবে জটিলতা হয়। প্রস্রাবের সমস্যার চিকিৎসায় সঠিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি। সঠিক সময় চিকিৎসা না হলে রোগ জটিল হয়ে উঠতে পারে।

প্রশ্ন : শিশু বা নবজাতকের প্রস্রাব সংক্রান্ত কী কী জটিলতা হতে পারে?

উত্তর : এখন তো গরমের সময় বাচ্চারা অনেক ক্ষেত্রে কম পানি খায়। আবার ঘামও বেশি হয়। এ জন্য সাধারণত প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে। জ্বালাপোড়া করলে বাচ্চারা প্রস্রাব করতে চায় না। মায়েরা একে বড় সমস্যা মনে করে। এ ছাড়া জন্মগত কিছু সমস্যা আছে, যার জন্য প্রস্রাবে সমস্যা হতে পারে। যেমন, প্রস্রাবের নালিতে একটা ভাল্ব থাকতে পারে। প্রস্রাবের নালিটা জন্মগতভাবে যেভাবে তৈরি হওয়ার কথা সেভাবে নাও হতে পারে। বাইরের যে ছিদ্রটা সেটা ছোট থাকতে পারে। এ ছাড়া বাচ্চাদের প্রস্রাবের সংক্রমণ হয়। পানি কম খেলে অথবা কোনো জন্মগত কারণ থাকলে এটি হয়। এই সংক্রমণ থেকে বাচ্চাদের প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়, অল্প অল্প প্রস্রাব বা ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাবের সমস্যা হয়।

মায়েরা এসব সমস্যা নিয়ে প্রায়ই আমাদের কাছে আসেন, তখন খেয়াল করে দেখি পানিশূন্যতা আছে কি না। বমি হয়েছে কি না। পাতলা পায়খানা হয়েছে কি না। কতটুকু পানি খাচ্ছে সেটা পর্যাপ্ত কি না। পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ খাচ্ছে কি না।

এই ঋতুতে বাচ্চাদের জ্বর হয়। জ্বর হলে বাচ্চারা কিছু খেতে চায় না। এমনকি দুধও খেতে চায় না। পানিও খেতে চায় না। যেটুকু খায় সেটুকু বমি করে ফেলে। এই বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে আমরা চিকিৎসা করি। যদি কেবল পানি খেলে সমস্যার সমাধান হয়, তবে খেতে বলি।

যদি বুঝি অন্য কোনো রোগের কারণে হচ্ছে, বিশেষ করে প্রস্রাবে যদি সংক্রমণ হয়, তাহলে একটা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করাতে বলি। আস্তে আস্তে এগুলো ঠিক হয়ে যায়।

প্রশ্ন : এই সাধারণ সমস্যার বাইরে আর কী কী ধরনের জটিলতা  রয়েছে?

উত্তর : এর বাইরে কিছু জিনিস আমি বলতে চাই, যেমন এর মধ্যে একটি হচ্ছে, যদি একটি বাচ্চা যদি জন্মের পর থেকেই ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব করে। প্রস্রাবটা দূরে না যায়, তাহলে এটি একটু চিন্তার কারণ। জন্মগতভাবে প্রস্রাবের থলি এবং প্রস্রাবের নালির মাঝখানে একটি পর্দা থাকতে পারে।

এটা আমরা বুঝব বিভিন্ন লক্ষণ দিয়ে। বাচ্চারা সাধারণত শুয়ে থেকে প্রস্রাব করলে অনেক দূরে প্রস্রাব যায়, বিশেষ করে ছেলে বাচ্চাদের। সেটা যদি না যায়, সব সময় যদি ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব পড়ে। কোনো কোনো সময় প্রস্রাব করতে কষ্ট হচ্ছে মনে হয়। কোনো কোনো বাচ্চা জন্মের পরপর যদি দেখা যায় প্রস্রাব পরিষ্কার হচ্ছে না আবার তলপেটে চাকার মতো পাওয়া যায় তাহলে এটা নিকটস্থ কোনো পেডিয়াট্রিক সার্জন বা পেডিয়াট্রিক ইউরোলজিস্ট দেখিয়ে পরামর্শ নিতে হবে।

প্রশ্ন : কী কারণে হচ্ছে এটি?

উত্তর : জন্মগতভাবে নালি এবং থলির মাঝখানে একটি পর্দা থেকে যায়। আমরা সাধারণত একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সমস্যাটি নির্ণয় করে এর চিকিৎসা করি। এখন তো খুব ভালো চিকিৎসা বের হয়েছে। বাচ্চাদেরও প্রস্রাবের নালির মধ্য দিয়ে ক্যামেরা প্রবেশ করে ওই ভাল্বকে পুড়িয়ে দিই। যেটাকে সিস্টোস্কোপ বলে। এটা খুব সহজ। আজকাল অনেক মেডিকেল কলেজেই এটা হচ্ছে। ন্যাশনাল ইউরোলজি সেন্টারে হচ্ছে। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হয়। আগে এই বাচ্চাগুলো চিকিৎসা সময় মতো নিত না বলে কিডনি নষ্ট হয়ে যেত। আস্তে আস্তে প্রস্রাব জমতে জমতে কিডনিতে সমস্যা হতো, কিডনি বড় হয়ে যেত।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অনেক সময় বাচ্চার বাইরের ছিদ্রটা পরিপূর্ণভাবে খোলা থাকে না। এর জন্য যে বেগে প্রস্রাবটা আসে সেই বেগে বের হতে পারে না। কিছু প্রস্রাব থেকে যায়। এটা বেলুনের মতো ফুলে যায়। এটাকে আমরা ফাইমোসিস বলি। এটা যদি নিয়মিত হয় তবে কোনো না কোনো সময় সংক্রমণ হতে পারে। যদি ছোট বাচ্চা হয় তবে ক্রিম দিয়ে ম্যাসেজ করলে এটা খুলে যায়। যদি না খুলে যায় তাহলে খুলে দিই। আর না হলে যদি মুসলমানি করে ফেলি, এর সমাধান হয়ে যায়।

প্রশ্ন : মুসলমানি বিষয়টি একটি শিশুর জন্য কখন দরকার এবং এটি সঠিক পদ্ধতিতে হচ্ছে কি না সেটি বোঝার উপায় কী?

উত্তর : আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে যে সামাজিক রীতিনীতি হয়ে আসছে এর বাইরে তো হুট করে যেতে পারে না। একটা সময় ছিল হাজামকে দিয়ে মুসলমানির কাজ করানো হতো। এখন তো ক্লিনিকের বিষয় চলে আসছে। মায়েরা প্রশ্ন করে বাচ্চাকে যদি ছোটবেলায় মুসলমানি করে ফেলি, তাহলে তো আর ব্যথা থাকবে না। বিষয়টি এ রকম না। এর একটি নির্দিষ্ট বয়স আছে। আমরা আদর্শগত যে বয়সটি বলি চার থেকে ছয় বছরের মধ্যে করতে হয়। এর মধ্যে বাচ্চাদের স্কুলিং     অতটা শুরু হয় না। একটা ছোট বাচ্চাকে ম্যানেজ করাও সমস্যা। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমাদের অনেকেরই ধারণা, ছোট বাচ্চা বুঝি ব্যথা পায় না। আসলে ব্যথা মায়ের পেটের মধ্যেও পায়। দেখা গেছে, যেই মায়েরা ঝগড়া করে তাদের মধ্যে মানসিক আঘাত পায়। তাই এই বিষয়টি মায়ের পেটে শুরু হয়।

আমরা ছোট বাচ্চাকে যদি মুসলমানি করে দিই, আজকাল প্যামপার্স ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। প্যামপার্স ব্যবহার করলে সব সময় জায়গাটা ভেজা থাকছে। ভেজা থাকলে প্রস্রাবের মধ্যে যে দুর্গন্ধ হয়, অ্যামোনিয়া থেকে, এর সংস্পর্শে এসে এখানে সংক্রমণ হয়। সংক্রমণ হলে ধীরে ধীরে প্রস্রাবের রাস্তাটা চিকন হয়ে যেতে পারে। ওখানে ঘা হতে পারে। চার থেকে ছয় বছরে তখন সহজে বিষয়টি করা যায়। পড়াশোনাও তখন শুরু হয় না। এটিই হচ্ছে আদর্শ সময়।

আর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে করতে হবে। কোন জায়গা কাটতে হবে, কতটুকু কাটতে হবে এর একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও রয়েছে। মায়েদের মনে অনেক ধরনের প্রশ্ন থাকে। কী ব্যবহার করা উচিত, গোসল করাতে হবে কি না, কাপড় পরানো ঠিক কি না, মলম লাগানো ঠিক কি না-এসব প্রশ্ন তো হাজাম বা সাধারণ ফিজিশিয়ান দিতে পারেন না। সতর্ক করে বলতে চাই, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। তাই মুসলমানি করতে গেলে সঠিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে করতে হবে। আমি মনে করি, বিশেষ করে পেডিয়াট্রিক সার্জনদের কাছে যাওয়াই ভালো।

প্রশ্ন : আরেকটি বিষয় বাবা-মায়েরা মনে করেন, ছোট বাচ্চাদের প্রস্রাবে সমস্যা হওয়া মানেই তার মুসলমানি করতে হবে। এ বিষয়ে কিছ বলুন।

উত্তর : এটা জন্মের পরপর সাধারণ বাচ্চাদেরও হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আমরা যদি ম্যাসেজ করি, তাহলে আস্তে আস্তে খুলে যায়। যেটা হয়, সাধারণ একজন চিকিৎসকের কাছে গেলে বলে মুসলমানি করে ফেলেন। অভিভাবকদের মধ্যে যদি এই সচেতনতাগুলো থাকে, এত ছোট বয়সে মুসলমানি করলে সমস্যা হতে পারে। তাহলে ভালো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রস্রাব পরিষ্কার হচ্ছে না মানে মুসলমানি করে ফেলতে হবে বিষয়টি এমন নয়।

বরং যদি আসলেই জায়গাটি চিকন থাকে যেটাকে আমরা ফাইব্রোসিস বলি, ফিউমোসিস বলি সেরকম হলে আমার মনে হয় মুসলমানি করা দরকার। আর কারো দ্বিধা মনে হলে সঠিক জায়গায় রেফার করে চিকিৎসা করতে হবে। আগে থেকেই সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে অবশ্যই যেতে হবে।

প্রাইমারি ফিজিশিয়ান অর্থাৎ যে চিকিৎসকের কাছে  প্রথম বাচ্চাটি দেখানো হয়, তাদের কথাটা মায়েরা বেশি গুরুত্ব দেয়। ওনারা যদি বলে মুসলমানি লাগবে, এর পাশাপাশিও একটু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে ভালো।

প্রশ্ন : প্রস্রাবের যেই জটিলতাগুলো কথা আপনি বলছিলেন সময়মতো যদি এর চিকিৎসাগুলো করা না হয় তবে কী ঝুঁকি হতে পারে?

উত্তর : যদি সংক্রমণ হয়, এটা থেকে কিডনিতে দাগ পড়ে যেতে পারে। কিডনিতে সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘদিন সংক্রমণ থেকে বাচ্চাদের পাথরও হতে পারে। বাচ্চাদের পাথর হলেও ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব পড়ে। সেটা বোঝার উপায় হলো, বাচ্চা দেখবেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব করছে এবং চিৎকার করছে। আর শিশ্ন ধরে নাড়াচাড়া করবে। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। তখন নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে গেলেই পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে পাথরটা এসে আটকে গেছে প্রস্রাবের রাস্তার মুখে। শরীরের সমস্ত বর্জ্য পদার্থ কিডনির দিয়ে ছেঁকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। তাই কিডনিটা পরিষ্কার থাকা দরকার। এগুলোর আস্তে আস্তে ক্ষতি হয়, চুল পাকার মতো।  কিডনির কোষ একটা দুটো করে নষ্ট হতে থাকে। বাবা মায়ের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুটির এসব বিষয়ে খেয়াল করা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।

অধ্যাপক ডা. মো. সামিদুর রহমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *