শিশুদের অধিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করবেন না

পড়াশোনাই ছাত্রদের তপস্যা। তবে এখনকার যুগের পড়াশোনা শুধু তপস্যায় সীমাবদ্ধ থাকে না। বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার। জীবন পরিণত হয়েছে যুদ্ধে। সেই যুদ্ধের প্রস্তুতি হলো পড়াশোনা। সেখানেও আরেক যুদ্ধের আবহাওয়া। কেজি ওয়ানের শিশু হয়তো প্রতিযোগিতার কিছু বোঝে না। কিন্তু তার পক্ষ হয়ে লড়ছে অভিভাবকরা। অভিভাবকদের মনোভাবের ফলে শিশুটি অল্প বয়সেই বুঝে নেয়, তাকে সেরা হতে হবে। আমিই সেরা হব—এমন একটা মনোভাব তৈরি হয় ছোট বয়স থেকেই। সব বয়সের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই চলে এই কঠিন প্রতিযোগিতা।

প্রতিযোগিতার ফলে শিক্ষার্থীরা প্রচুর পড়ে, ভালোভাবে চেষ্টা করে। তাদের ভালো ফলাফলও হয়। প্রশংসা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর। শিক্ষকরা প্রতিযোগিতায় উসকে দেন শিক্ষার্থীদের। অভিভাবকরাও সন্তুষ্ট হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক গবেষণায়ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ফল ভালো বলে জানা গেছে।

তবে প্রতিযোগিতা যেন সুস্থ হয়, সে বিষয়ে লক্ষ রাখা জরুরি। অনেক সময় এই প্রতিযোগিতা অসুস্থ পর্যায়ে চলে যায়। এর প্রভাব পড়ে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। ‘আমাকে ভালো করতে হবে, সেরা হতে হবে—যেকোনো কিছুর বিনিময়েই এটা করব।’ এমন চিন্তা অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। ফলে ছাত্রদের মধ্যে সাধারণ বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, মমত্ববোধ, সৌহার্দ্য—এসব মানবিক গুণ হ্রাস পায়। বন্ধুত্বের স্বাদই পায় না অনেক শিশু। অনেক সময় অন্যের ক্ষতি হোক, পিছিয়ে যাক এমন কামনা করে। কেউ কেউ ভালো ফলের জন্য আইন অমান্য করে অসৎ পন্থাও অবলম্বন করে।

অভিভাবকরাও এমন প্রতিযোগিতায় উৎসাহ দেন শিশুকে। ‘তুই ভালো করতে পারিস না? সে এত ভালো করল! তোকে এত টাকা খরচ করে পড়াই!’—এমন ধরনের তুলনা করেন অনেকে। অভিভাবকদের পাশাপাশি স্কুল ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। আমার স্কুল থেকে সবকটি বাচ্চাকে উত্তীর্ণ হতে হবে। সবাইকে জিপিএ ফাইভ পেতে হবে। বোর্ডে সবচেয়ে ভালো ফল করা স্কুল হিসেবে আমার স্কুলের নাম আসতে হবে। অভিভাবক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন মনোভাব ছাত্রটির মনোবলে ভীষণ আঘাত করে। সে লেখাপড়ায় আর ভালো করতে পারে না। অধিক প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের ফলে শিশুটির মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, হতাশা, পরীক্ষাভীতি, স্কুল-ফোবিয়া, কনভারশন ডিজঅর্ডার, রাগ ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়।

সব শিশু সমান সাফল্য পায় না। সবার পড়ার দক্ষতাও সমান থাকে না। কেউ যদি বারবার পড়ায় খারাপ করতে থাকে, তখন তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। অধিক প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়লে এটা আরো বেশি হয়। সেই শিক্ষার্থী ভাবতে শেখে, ‘আমি পারি না। আমাকে দিয়ে হবে না। আমি খারাপ ছাত্র।’

অধিক প্রতিযোগিতার চাপ সব শিশু নিতে পারে না। ভয় পেয়ে যায়। ফলে সামগ্রিকভাবে তার কর্মদক্ষতা খারাপ হয়। পড়ায় খারাপ করা শুরু করে। ভয়ে কেউ কেউ পরীক্ষা দেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া বা পড়া বন্ধ করে দেয়।

উপায় কী

* সুস্থ প্রতিযোগিতায় উৎসাহিত করতে হবে। প্রতিযোগিতার মধ্যে সাহায্য করার প্রবণতাও থাকবে।

* শিক্ষার্থীর গত বছরের ফলের সঙ্গে এ বছরের ফলের তুলনা করা যায়। তাও খুব সমালোচনামুখর না করাই ভালো।

* শিক্ষার্থীর মনে খুব কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। তাকে অপমানসূচক কথাবার্তা বলা বন্ধ করতে হবে।

* শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে। অভিভাবকরা বলবেন যে তারা শিশুটির দক্ষতায় আস্থাশীল।

* শিক্ষার্থীকে খুব বড় ধরনের টার্গেট বেঁধে দেওয়া ঠিক নয়। তাতে সে হতাশ হয়ে চেষ্টা ছেড়ে দিতে পারে।

* ভালো করলে অভিভাবক ও শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রশংসা করবেন।

* অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের পড়ায় উৎসাহিত করবেন। একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রতিযোগিতায়ও উৎসাহ দেবেন। কিন্তু ভালো হয় যদি তাঁরা শিশুর সঙ্গে অন্য শিশুর তুলনা না করেন। তাঁরা বলতে পারেন, ‘তুমি পড়ায় সামর্থ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করো। তাতেই আমরা খুশি। তুমি ভালো করো আর খারাপই করো, সেটি বড় নয়। ফল যা-ই করো না কেন, তুমি আমাদের সন্তান। আমরা তোমাকে ভালোবাসি। খারাপ করলেও ভালোবাসব, ভালো করলেও ভালোবাসব। এটি শর্তহীন ভালোবাসা। খারাপ করলে আমরা তোমাকে ভালো করতে সাহায্য করব। তোমার দুঃখে আমরা দুঃখী হব। ভালো করলে তোমার আনন্দে আমরা আনন্দিত।’

* স্কুলগুলোকে শিক্ষাকেন্দ্র হতে হবে। মেধাবী ও কম মেধাবী সবাই ছাত্র। যার যার কাছ থেকে তার সামর্থ্যমতো সর্বোচ্চ ফল আদায় করার চেষ্টা করতে হবে। ভয়ভীতি না দেখিয়ে বা স্কুল থেকে বহিষ্কার না করে তাকে দিয়ে পড়িয়ে নেওয়া, তাকে পাঠদান করায় আসল সাফল্য।

* যদি অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফল হিসেবে বা অন্য কোনো কারণে শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যা হয়, তবে অভিভাবক মনোচিকিৎসকের সহযোগিতা নিতে পারেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও মনোস্তাত্ত্বিক সেবা নিশ্চিত করা উচিত। এ জন্য মনোবিজ্ঞানীদের নিয়োগ করা যেতে পারে।

* শিক্ষা বোর্ড ও সরকার কতজন ছাত্রছাত্রী পড়ছে আর কতজন পড়া বাদ দিল, কেন বাদ দিল, তাদের পড়ায় ফেরাতে কী করা যায়—এসব বিষয়ে সরকার যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্যও করতে পারে।

লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *